১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলা কালীন সময় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে আত্মসর্মপণ করে। অন্যান্য অঞ্চল ও মুক্ত হয়ে গেলেও রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া ১৮ ডিসেম্বর ও নাটোর ২১ ডিসেম্বর মুক্ত হয়।
৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিয়েছে খবরে মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ নং সেক্টরের রাজশাহী, নওগাঁ, বগুড়া, নাটোর ও আশপাশ অঞ্চলের পরিস্থিতি পাল্টে গেল। সাংবাদিক মরহুম মঞ্জুরুল হক ও তখনকার তরুন সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দীনের তথ্যে জানা যায়,পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থক বাঙালি, অবাঙালিরা স্বাধীনতাকামীদের সর্ম্পকে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামীরা সাহসী হয়ে উঠে । মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থকরা ৭ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলা সদরে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে জোর করে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মিছিল সমাবেশ করায়। বিভিন্ন পাড়া মহল্লার মানুষ জড় করে মিছিল সমাবেশ করাতে থাকলেও স্বাধীনতাকামীরা সব কিছু উপেক্ষা করে বিজয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মিত্রবাহিনীর বিমান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পনের প্রচার পত্র ছড়ানো হচ্ছে মুখে মুখে এখবর ছীড়য়ে পড়তে থাকলে স্বাধীনতাকামীরা মিত্রবাহিনীর বিমানকে স্বাগত জানানোর জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে, বিজয় অর্জন কেবল মাত্র সময়ের ব্যাপার । নির্যাতন ভয় সব কিছু অপেক্ষা করে স্বাধীনতাকামীরা স্বাধীন বাংলা বেতার বিজলী বেতার, বিদেশী বেতার শুনতে থাকলে, পাকিস্থানি সৈন্য ও তাদের সমর্থক বাঙালি, অবাঙালিরা নির্যাতন ও হত্যা কান্ডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া। পাকিস্তান সৈন্যদের সাহায্য করতে আসা ৭ম নৌবহর সোভিয়েত ইউনিয়নের বাধার কারনে ফিরে যাচ্ছে জেনে স্বাধীনতাকামীরা আরো বেশি সাহসী হয়ে উঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকশন অপারেশনে পাকিস্তানের সৈন্যরা নাজেহাল হয়ে মুক্ত অঞ্চলগুলো দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতে থাকে। বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা দূরুল হুদার তথ্যে জানা যায়, রাজশাহী জেলার তৎকালীন চাপাইনবাবগঞ্জে মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত করে রাজশাহী জেলা সদর সহ আশেপাশের অঞ্চল মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে অ্যাডভান্সের সময় ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেহাইচরে ৭ নং সেক্টরের মহদিপুর সাব সেক্টর ৩ এর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর শহিদ হলে মুক্তিযোদ্ধারা বিছিন্ন হয়ে যায়। লালগোলা সাব সেক্টর ৪ এর কমান্ডার মেজর গিয়াসউদ্দীন আহম্মেদ চৌধুরী ও অন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ করে পরের দিন ১৫ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্ত করে সেক্টর কমান্ডার শহিদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ সোনা মসজিদে দাফনের জন্য প্রেরন করেন। মুক্তিবাহিনী রাজশাহীর দিকে অ্যাডভান্সের প্রস্তুতি নিচ্ছে এ খবর বাজশাহী জেলা সদরে চলে আসে। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরের পর পাকিস্থানি সৈন্যরা ঢাকায় আত্মসর্মপণ করবে। মুখে মুখে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজশাহীতে অবরুদ্ধ থাকা স্বাধীনতাকামীরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে পড়ে। নানা স্লোগান শোনা যেতে থাকে। রাজশাহী জেলা সদরের বোয়ালিয়া থানার বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হওয়া মীর আফজাল হোসেন বাবলার তথ্যে যানা যায়, তিনি বোয়ালিয়া থানা ও বেতার কেন্দ্রে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে যেখানে সেখানে পড়ে থাকা অস্ত্র সংগ্রহ করে থানায় জমা দেন। স্বাধীনতা কামী স্বাধারন মানুষে তাকে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জোহা হল ক্যাম্পে থাকা পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের সবকিছু গুটিয়ে ফেলে বিভিন্ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠান থেকে লুট করা টাকায় আগুন দেয়। সাংবাদিক মনজুরুল হকের তথ্যে জানা যায় মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী দলের চার সদস্য সাদা পতাকা, সাদা পাগড়ি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পনের নির্দেশনার বার্তাটি পৌছে দিতে রাজশাহীতে এলে তিনি তার মায়ের তৈরি করা চা পান করিয়ে তাদের অ্যাপায়ন করেন। ওই চার সদস্য আত্মসমর্পনের বার্তাটি পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে পৌছে দেয়। ইতিমধ্যে রাজশাহী জেলা সদরের আশে পাশের গ্রাম গুলি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। রাজশাহী জেলা সদরের বিভিন্ন সেল্টারে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী জেলা সদরের নিয়ন্ত্রন নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প থেকে বন্দি ও নির্যাতিত দের ছেড়ে দিতে থাকে। স্বজনদের খোঁজে বন্দি শিবীর ও নির্যাতন ক্যাম্পের আশে পাাশে ভিড় বাড়তে থাকে। বিজয়ের আনন্দ ও স্বজন হারানো শোকে মাখা রাজশাহী নানা স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহী জোহা হলের ক্যাম্প থেকে মুক্ত হয়ে আশা ন্যাপ নেতা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জননেতা আতাউর রহমান স্বাধীনতা কামীদের প্রস্তাবে তার সিপাহি পাড়া বাড়িতে কন্ট্রোল রুম করেন। সকলের প্রস্তাবে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বহিনী কে বরন ও তৎকালীন মাদ্রাসা হাইস্কুল মাঠে বিজয় সমাবেশ করার উদ্দ্যেগ নেয়। রাজশাহীর দিকে অ্যাডভান্স হওয়া মুক্তিবাহিনী বরণ করে নিতে নানা প্রস্তুতি চলতে থাকে।
রাজশাহীর জেলা সদরের দিকে অ্যাডভান্স হওয়া মুক্তিবাহিনী
পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থক, বাঙালি ও অবাঙালির ষড়যন্ত্র করতে থাকে। অনেকে মুখোশ পাল্টিয়ে নিজ এলাকায় গিয়ে স্বাধীনতাকামী হয়ে যায় দিয়ে। সন্ধ্যায় রাজশাহী জেলা সদরে অ্যাডভান্স হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাপ পানি, ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে বরন করে নেয়া হয়। তাদের রাজশাহী কলেজে ও অন্যান্য জাগায় থাকার ব্যবস্থা করে খাবার সরবরাহের আহ্বানে পাড়া-মহল্লা, বাড়ি থেকে খাবার সরবরাহ হতে থাকে । মুক্তিযোদ্ধাদের আসার পর মিত্রবাহিনী আসে। ১৮ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার বিজয় মিছিল শেষে রাজশাহী হাই মাদ্রাসা স্কুল ( বর্তমানে হাজি মুহাম্মদ মহসিন হাইস্কুল ) মাঠে ৭ নং সেক্টরের লালগোলা সাব সেক্টর ৪ এর কমান্ডার মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে রাজশাহীকে মুক্ত ঘোষণার পরও কিছু অবাঙালি, বাঙালি, দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা করতে থাকে।
রাজশাহীর জেলা সদরের মুক্তিযোদ্ধা জনতার বিজয় মিছিল।
পদ্মা নদী পাড় হয়ে রাজশাহী জেলা সদরে আসা মুক্তিযোদ্ধারা, মুক্ত রাজশাহী জেলা সদরে পতাকা তুলছেন লালগোলা সাবসেক্টর ৪ এর সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা তৎকালীন মেজর গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী বীরবিক্রম
বীর মুক্তিযোদ্ধা এস এম সিরাজুল ইসলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হাসান তারেক বীর বিক্রম ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসানুজ্জামান ভুলু র তথ্যে জানা যায়, তখনও রাজশাহী জেলার তৎকালীন নঁওগা মহকুমা,বগুড়া ও নাটোর মহকুমায় অ্যাকশন চলতে থাকে। শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা টিকতে না পেরে নঁওগা ও বগুড়ায় আত্মসমর্পন করে।স্বাধীনতাকামী জনতা বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বহিনী কে বরণ করে নেয়।
নঁওগার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকের অফিস পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসর্মপন স্থল, বগুড়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ্ আত্মসর্মপন করছেন মিত্র বাহিনীর মেজর জেনারেল লচমন সিং এর কাছে। ছবি ঃ হামিদুল হোসেন তারেক (বীরবিক্রম)
সাংবাদিক মনজুরুল হক ও তখনকার তরুণ সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিনের তথ্য জানা যায় , দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা দমনে বিবেকবান কিছু অবাঙালি ভুমিকা রাখেন। সাব-সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়ে সকলকে শান্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে রাজশাহীর তৎকালিন পৌরসভা ভবনে কন্ট্রোলরুম করেন ।
ষড়যন্ত্রকারী বাঙালি, অবাঙালিদের নিরস্ত্র করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হল ও বিভিন্ন নির্যাতন ক্যাম্প থেকে নির্যাতিত নারী ও অন্যদের উদ্ধার করে বাঙালিদের সহযোগিতা করা বিবেকবান অবাঙালিদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জননেতা আতাউর রহমান,পানিপিয়া ক্যাম্প ডেপুটি ইনচার্জ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা আব্দুল হাদী ও অন্যরা রাজশাহীতে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ভূমিকা রাখেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বদ্ধভূমি সহ বিভিন্ন বদ্ধভূমি থেকে অগনিত শহিদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। ২১ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলার তৎকালিন নাটোর মহকুমা দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি মাঠে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহম্মেদ আশরাফ ও ভারতীয় বাহিনীর মাউন্টেন ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার রঘুবীর সিং এর আত্মসর্মপন দলিলে স্বাক্ষর করার পর নাটোর মুখরিত হয়ে উঠে।
নাটোরে আত্মসর্মপন করছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ছবিঃ আব্দুর রাজ্জাক সৌজন্য আহমেদ সফিউদ্দীন
বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দীনের তথ্যে জানা যায় রাজশাহী ও তার আশেপাশে ১২৩ টির মত অ্যাকশন অপারেশন সংগঠিত হয়। সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিনের তথ্য জানা যায়, পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থকদের নিয়ন্ত্রিত রাজশাহী প্রেসক্লাব রাখা হত্যা তালিকা তারা খুজে বের করেন রাজশাহীর জেলা সদরের বিভিন্ন দেয়ালের বড় বড় করে লেখা হয় ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ । নতুন মাটির নতুন দেশ তোমার আমার বাংলাদেশ। মাইকে বাজতে থাকে দেশাত্ব বোধক গান। একটি বিষয় সবার জানা প্রয়োজন বাংলাদেশ সরকার দেশ পরিচালনা করলেও ঢাকা মিরপুর ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তান পন্থি অবাঙালি দের নিয়ন্ত্রনে থাকে। মিত্র বাহিনী বিহার রেজিমেন্ট দায়িত্বে ব্যার্থ হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট সুসাইড অ্যাকশনের মাধ্যমে বীরত্ব পূর্ন ভূমিকা ও জীবন উৎসর্গের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চল কে মুক্ত করে। (তথ্য সূত্র রাজনৈতিক কর্মী রাফি আহমেদ বিদ্যুৎ,দৈনিক প্রথম আলোর ছুটির দিনে ২৫ মার্চ ২০০০ সাল )
লেক্ষক উপদেষ্টা, নিরাপদ সড়ক চাই, রাজশাহী জেলা শাখা. সমাজ ও সাস্কৃতিক কর্মি সহযোগিতায়ঃ ফাহিম এস লিমন।