রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫
Logo
Blind loyalty to politics

রাজনীতির অন্ধ আনুগত্য: জাতীয় ঐক্য বা বিভাজনের সৃষ্টি?

Bijoy Bangla

আনোয়ার শাহজাহান

প্রকাশের সময়: ০৯ জানুয়ারি, ২০২৫, ১০:৩৫এএম

রাজনীতির অন্ধ আনুগত্য: জাতীয় ঐক্য বা বিভাজনের সৃষ্টি?
লেখক আনোয়ার শাহজাহান

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক ধরনের অদ্ভুত আসক্তিতে পরিণত হয়েছে, যা পৃথিবীর খুব কম দেশেই দেখা যায়। রাজনীতি যেন আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাব আমাদের চিন্তা, আচরণ, কাজ, সম্পর্ক, এমনকি আমাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনেও প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যান্য দেশের মানুষ রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করে ঠিকই, তবে সেটি তাদের জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মাঝে একটি মাত্র বিষয় হিসেবে থাকে। অথচ, বাংলাদেশে রাজনীতি হয়ে উঠেছে জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আমাদের সমাজ এবং সংস্কৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।

রাজনীতি কখনো কখনো জাতির উন্নতির পথে অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তা অনেক সময় বিরোধ এবং বিভেদ সৃষ্টি করে। দেশের প্রায় প্রতিটি স্তরে, বিশেষ করে মানুষের মনস্তত্ত্বে, রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি এক অদ্ভুত আনুগত্য দেখা যায়। এ ধরনের আনুগত্যের কারণে সত্য, বাস্তবতা এবং বাস্তব পরিস্থিতির স্বীকৃতি দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। দলীয় আনুগত্য এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলোকেও তৃতীয় অবস্থানে ঠেলে দেয়। নেতাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য কখনো কখনো পরিবারের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব এবং সমাজিক দায়িত্বের থেকে বড় হয়ে ওঠে, যা সমাজে এক ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশে পারিবারিক সম্পর্কগুলোও কখনো কখনো রাজনীতির প্রভাবে ভেঙে যায়। সমাজে বিভাজন সৃষ্টি হয়, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে অপরকে নিন্দা এবং ঘৃণার মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার প্রবণতা বাড়ে। আমাদের দেশের রাজনীতি অনেক সময় ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং প্রতিশোধের জায়গায় চলে যায়, যেখানে দেশের উন্নতি বা সাধারণ জনগণের কল্যাণের বিষয়টি দ্বিতীয় দৃষ্টিতে পড়ে। মানুষের দৃষ্টি আর্কষিত হয় নেতাদের দোষ এবং অপরাধে, অথচ প্রকৃত সমস্যাগুলোর দিকে আমাদের নজর পড়ে না।

বিশ্বের প্রায় ৩০-৩৫টি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি, পৃথিবীর কোন দেশেই রাজনীতি কখনো জীবনের একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে না। অন্যান্য দেশগুলোতে, যদিও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা চলে, তা সবার জীবনের অন্যান্য দিকের সাথে একত্রিত থাকে। তারা সমাজ, শিক্ষা, প্রযুক্তি এবং উন্নয়নমূলক কাজের পাশাপাশি রাজনীতিকেও গুরুত্ব দেয়, তবে রাজনীতি কখনো একমাত্র কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাংলাদেশে তা যেন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি, এমনকি যেকোনো বিষয়ের আলোচনা করতে গেলেই রাজনীতি এ-ই প্রভাব বিস্তার করে।

স্বাধীনতার পর ৫৪ বছর পার হলেও, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, কিংবা দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়গুলি এখনও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে আছে। অথচ এই বিতর্কগুলো একসময় জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত হলেও, এখন তা জাতির অগ্রগতির পথে একটি বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু বিভক্তি, ঘৃণা এবং বিদ্বেষের প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা আমাদের সমগ্র জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি আমাদের কেবল পরস্পরের প্রতি ক্ষোভ ও আক্রোশ বাড়ায় এবং জাতিগত উন্নতির পথে একটি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব একদিকে যেমন জাতির অগ্রগতি থামিয়ে দিয়েছে, তেমনি আমাদের ব্যক্তি জীবনেও এর গভীর প্রভাব পড়েছে। যখন মানুষ রাজনীতি নিয়ে এতটা উন্মত্ত হয়ে ওঠে, তখন তারা তাদের পরিবারের প্রয়োজন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং দেশের উন্নতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পাশ কাটিয়ে যায়। ব্যক্তিগত জীবন এবং সমাজে তাদের মনোযোগের ঘাটতি দেখা যায়, যা জাতির সমৃদ্ধি এবং অগ্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

আজকের পৃথিবী যেখানে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান এবং সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে, সেখানে আমরা পুরনো রাজনৈতিক বিতর্কগুলোর মধ্যে আটকে আছি। যখন পৃথিবী উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা অতীতের শত্রুতা এবং ভুল সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে নিজেদের নিয়ে বসে আছি। বিশ্বের অনেক দেশ দ্রুততার সাথে উন্নতি করছে, কিন্তু আমাদের দেশ পুরনো রাজনীতি ও ঐতিহাসিক শত্রুতার কারণে থমকে গেছে।

এক্ষেত্রে, রাজনীতি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তবে কখনোই এটি আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হতে পারে না। রাজনীতি দেশের উন্নতির জন্য অপরিহার্য হলেও, এর প্রভাব কখনোই ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনের মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত নয়। আমাদের উচিত রাজনীতির মধ্যে বিভক্তির বদলে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মানের ভিত্তিতে সমাজের উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করা। কেবল তখনই আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ, সমৃদ্ধ এবং উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারব।

রাজনীতিবিদদের কাছে আমরা বারবার হোঁচট খাচ্ছি, অবহেলার শিকার হচ্ছি এবং মৌলিক অধিকার এবং জীবনযাত্রার জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষদের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য নিজেদের শক্তি এবং সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে গিয়ে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আর নেতারা, যারা আমাদের আস্থা ও ভোটে ক্ষমতায় আসেন, তারা নিজেদের পরিবারের স্বার্থরক্ষা এবং বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়তে ব্যস্ত। তারা আমাদের জনগণের দুর্দশা, দারিদ্র্য এবং অভাবকে একেবারেই গুরুত্ব দেন না। তবুও, আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারি না, তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক কণ্ঠ হয়ে কথা বলতে পারি না।

এক্ষেত্রে, প্রশ্ন জাগে—কেন আমরা আমাদের অধিকার এবং মর্যাদার জন্য দাঁড়িয়ে কথা বলি না? কেন আমরা প্রতিবাদ করি না, যখন আমাদের সামনে স্পষ্ট সত্য থাকে? কেন আমাদের ক্ষোভ এবং বিক্ষোভ এক অদৃশ্য শক্তির কাছে চাপা পড়ে যায়? কেন আমরা নিজেদের নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলি না?

সমাজের প্রতিটি স্তরে রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব যে গভীর, তা আমরা সবাই ভালো করেই জানি। এরপরও কেন আমরা তাদের বিরুদ্ধে একত্রে সোচ্চার হতে পারি না? কেন রাজনীতি এত শক্তিশালী হয়ে আমাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করেছে এবং সমাজে অস্থিরতা তৈরি করেছে?

এই প্রশ্নগুলো আমাদের সমগ্র জাতিকে ভাবতে বাধ্য করে। যদি আমরা আমাদের ভবিষ্যতের উন্নতি চাই, তবে আমাদের উচিত রাজনৈতিক বিভাজন বাদ দিয়ে জাতির কল্যাণে একত্রিত হয়ে কাজ করা। তখনই কেবল আমরা একটি উন্নত, ঐক্যবদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ জাতি গঠন করতে পারব।

লেখক :আনোয়ার শাহজাহান, ৬ জানুয়ারি, লন্ডন, যুক্তরাজ্য।