বৃহস্পতিবার, জুন ১২, ২০২৫
Logo
Alkap is worried about the song

রাজশাহী অঞ্চলের আলকাপ গান নিয়ে শঙ্কিত শিল্পী-কলাকুশলীরা

Bijoy Bangla

নিজস্ব প্রতিবেদক:

প্রকাশের সময়: ৩০ মার্চ, ২০২৫, ০৪:১১পিএম

রাজশাহী অঞ্চলের আলকাপ গান নিয়ে শঙ্কিত  শিল্পী-কলাকুশলীরা
রাজশাহী অঞ্চলের ঐহিত্যবাহী লোক সংস্কৃতি আলকাপ গান।......সংগৃহীত ছবি

রাজশাহী অঞ্চলের ঐহিত্যবাহী লোক সংস্কৃতি আলকাপ গান। বিশেষ করে দেশের উত্তর-পশ্চিমের সর্বশেষ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের গ্রাম জনপদে আলকাপ গানের শতাব্দী প্রাচিন ঐতিহ্য ও খ্যাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আলকাপ গান পালাগানেরই একটি অঙ্গ। কবি গানের মতোই আলকাপ গান খোলা মাঠে বাদ্যভাণ্ড সহযোগে পরিবেশিত ও গীত হয়ে থাকে। এই গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও পদ্য সহযোগে গান  পরিবেশন করা । আলকাপকে পঞ্চরসের গানও বলা হয়ে থাকে। আলকাপ গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষদের জীবনধর্মী হাস্যরসাত্মক জনপ্রিয় ও শক্তিশালী বিনোদন ধারা। আলকাপ পালার আসর দুই দলের তুমুল  প্রতিযোগীতায় আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।       

লেখক-গবেষকদের মতে, অত্যন্ত জনপ্রিয় গ্রামীণ এই লোক সংস্কৃতির উৎসভূমি হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা গ্রাম। এই গ্রামের বোনা কানাইকে আলকাপের জনক ভাবা হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আলকাপ ছিল অন্যতম প্রতিবাদের সাংস্কৃতিক মন্ত্র।  আলকাপ গানের মধ্যে রয়েছে সাম্প্রদায়িক ও সামাজিক মেলবন্ধনের চমৎকার উপকরণও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও পার্শ্ববতী ভারতের মুর্শিদবাদ, বীরভুম, মালদা ও  বিহার অঞ্চলেও আলকাপ গানের ধারা বিস্তৃত।

লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আলকাপ গানের মাধ্যমে প্রাণবন্ত ও জীবন্ত হয়ে উঠে। শিল্পী কলা কূশলীদের দলবদ্ধ পরিবেশনায় মুগ্ধ হন গ্রামীণ দর্শকেরা। আলকাপ দলের প্রধানকে বলা হয় সরকার। একটি আলকাপ দলে ১৪/১৫ জন শিল্পী কলা কূশলী থাকেন। একাধিক নাচিয়ে ( ছোকরা) দোহরী, ক্যাঁইপ্যা (জোকার) থাকেন। আলকাপ দলে যন্ত্রশিল্পী থাকেন ৭/৮ জন। আলকাপ পালার প্রধান আকর্ষণ থাকেন পুরুষ ছোকরা যারা নারী সেজে নৃত্য গীত পরিবেশন ও অভিনয় করেন। এই ছোকরাদের বলা হয় নাচিয়ে। ক্যাঁইপ্যারা সমসাময়িক বিষয়কে উপজীব্য করে হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে সমাজের নানান অসঙ্গতি দর্শকদের সামনে জীবন্ত করে তুলে ধরেন। 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি দশকে আকাশ প্রযুক্তির প্রসারে আলকাপ গানেরও জনপ্রিয়তা না কমে বরং বেড়েছে। পূর্বকালে গ্রাম জনপদের সাধারণ মানুষ আলকাপ গানের একমাত্র দর্শক শ্রোতা থাকলেও প্রযুক্তির কল্যাণে এখন ইউটিউবেও আলকাপ গান ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। এতে আলকাপ শিল্পী কলা কূশলীদের পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বাড়লেও হালআমলে অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইনের গ্যাঁড়াকলে পড়েছে জনপ্রিয় এই লোক গান। গত বছর শারদীয় দূর্গোৎসবে আলকাপ গানের অনুমতি মেলেনি রাজশাহী অঞ্চলের কোথাও। ফলে গভীর হতাশায় পড়েছেন আলকাপের সহস্রাধিক শিল্পী কলা কূশলী সঙ্গে দর্শকেরাও। দূর্গা পুজা উপলক্ষে এবার কোথাও বায়না পায়নি আলকাপ গানের খ্যাতিমান দলগুলি। রাজশাহী অঞ্চলের নবান্ন উপলক্ষে গ্রামীণ মেলাগুলিতেও আলকাপ গানের আসর আলকাপপ্রেমি মানুষদের কাছে বড় আকর্ষণ হয়ে উঠে। সামাজিক ও প্রশাসনিক অনুদারতায় আলকাপ দলগুলি এখন ধুঁকছে।    

জানা গেছে, রাজশাহী অঞ্চলের শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতেই রয়েছে তালিকাভুক্ত আলকাপ গানের ১২টি দল। নওগাঁর নিয়াতমপুর, রাজশাহীর তানোরসহ বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে আরও কয়েকটি জনপ্রিয় আলকাপ গানের দল। এসব দলের সঙ্গে যুক্ত আছেন তিন শতাধিক শিল্পী কলা কূশলী। গান ছাড়া  যাদের আর কোন পেশা নেই। আলকাপের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল এসব লোক শিল্পীরা। দশকের পর দশক ধরে  নানা বাধা বিপত্তি পার হয়ে এলেও নতুন প্রেক্ষাপটে আবারও প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে আলকাপ গান। আলকাপ শিল্পীরা বলছেন, নিরাপত্তার কারণে প্রশাসন থেকে অনুমতি না হওয়ায় গত দূর্গা পুজা উপলক্ষে তাদের কোন বায়না হয়নি। ফলে কোথায় আলকাপ পালা হয়নি।  আলকাপের শিল্পী কলা কূশলীরা এখন হতাশ ও বেকার। তবে আলকাপ শিল্পীদের অনেকেই বলেছেন, শুধু প্রশাসনই নয়, স্থানীয়ভাবে অনেক পূজা কমিটি আলকাপের আসর বসাতে অনীহা দেখিয়েছেন। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে আলকাপ গানের দলগুলি।

নওগাঁর নিয়ামতপুরের মহামায়া পঞ্চরস আলকাপ দলের সরকার (প্রধান) স্বপন বর্মণ বলেন, গত কয়েক বছরে রাজশাহী অঞ্চলে লোকগান আলকাপের বেশ প্রসার ঘটছিল। আমরা সরকারের শিল্পকলা বিভাগের আয়োজনেও আলকাপ পালা পরিবেশন করেছি। মাঝে করোনায় দেড় বছর বেকার ছিল আলকাপ শিল্পীরা। আগে দূর্গা পুজা উপলক্ষে ১০/১২ করে আসরের বায়না হতো। গত দূর্গোৎসবে আয়োজকরা আমাদের জানিয়েছিলেন তারা প্রশাসন থেকে আলকাপের অনুমতি পাচ্ছেন না।  তার দলের কয়েকটি জায়গায় বায়না হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। স্বপন আরও বলেন, আলকাপ গান একটি জনপ্রিয় লোকগান। এই লোক সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে আলকাপের বিষয়ে সরকারের উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।       

রাজশাহী অঞ্চলে আলকাপের অত্যন্ত সুপরিচিত নাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেজাউল ইসলাম কালু বা কালু সরকার। তাকে আলকাপপ্রেমিরা কালু ক্যাঁইপ্যা নামেই বেশি চেনেন। কালু বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় আলকাপ গান অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোক গান। গ্রামীণ মেলা ও পূজা পার্বন উপলক্ষে আলকাপের আয়োজন হয় বেশি।  এখন আলকাপের বায়না কম হচ্ছে। এরপরও গত কয়েক মাসে আমরা দু একটি পালা করেছি বিভিন্ন স্থানে।  তবে তা খুবই সীমিতভাবে। আমরা শিল্পীরা আলকাপের ভবিষ্যত নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত।  

রাজশাহীর তানোরের আলকাপ দলের জনপ্রিয় নাচিয়ে বাদল কর্মকার বলেন, আলকাপ গান রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের প্রধান লোক সংস্কৃতি। গত কয়েক বছরে আলকাপের প্রসার ঘটছিল। মাঝে কয়েক বছর আলকাপ গান হারিয়ে যেতে বসেছিল। গত কয়েক বছর আমরা বারো মাসই আলকাপ পরিবেশন করেছি।  কিন্তু হঠাৎ করেই এবার বায়না হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আলকাপ গান করে আমরা জীবন জীবিকা নির্বাহ করি। তিনি বলেন, আলকাপ শিল্পী কলা কূশলীরা অধিকাংশই খেটে খাওয়া মানুষ। জনপ্রিয় এই লোক সংস্কৃতিকে বাঁচাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সুদৃষ্টি দেওয়া উচিৎ। এতে বহু প্রাচিন এই লোক সংস্কৃতি যেমন প্রাণ ফিরে পাবে তেমনি আলকাপ শিল্পীরাও বাঁচতে পারবে। 

আলকাপ গানের অনুমতি বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কালচারাল অফিসার মো. ফারুকুর রহমান ফয়সাল বলেন, আলকাপ চাঁপাইনবাবগঞ্জের নিজস্ব লোক সংস্কৃতি। বিচিত্র পরিবেশনার গুণে এটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় একটি পালা গান। প্রশাসন থেকে লোক সংস্কৃতির আয়োজনে কোন বিপত্তি আছে বলে আমার জানা নেই। তবে আলকাপ যাত্রা পালার জন্য স্থানীয়ভাবে পুলিশ প্রশাসন মৌখিক অনুমতি দিয়ে থাকেন। গত মওসুমে নিরাপত্তার কারণ দেখেিয় অনুমতি দেওয়া হয়নি। আমিও জেনেছি এখন আলকাপের তেমন বায়না হচ্ছে না। দলগুলি শিল্পী কলাকুশলীরা প্রায় বেকার বসে আছেন। বিষয়টি জেনে আমারও খারাপ লাগছে।