অখণ্ড ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক অঞ্চল বীর চট্টলা(চট্টগ্রাম)। মাষ্টার দা সুর্য সেন ও তার সঙ্গীরা এখানে গড়ে তুলেন সশস্ত্র পটভুমি। বীর চট্টলার বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার রানী সুর্য সেনের একনিষ্ট, বিশ্বাসী ও মেধাবী সহকর্মী। যদিও তার ছোট বেলাটি ছিল অন্যরকম। ১৯১১ সালের ৫ই মে তার জন্ম হয় খুবি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। কিন্তু পরবর্তী জীবনে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্র সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করে হয়ে গেলেন ইতিহাস। তার বাবা জগবন্ধু চট্টগ্রাম পৌরসভায় চাকুরী করতেন। আদর করে প্রীতিলতার নাম দেন রানী। মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার সপ্ন দেখতেন তাদের আদরের রানী এমন একটা কিছু করবে যা হয়ে যাবে ইতিহাস। সাত ভাই বোনদের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। চট্টগ্রাম ডাক্তার খাস্তগির গার্লস হাই স্কুলে পড়ার সময় তার ধারণা ছিল বিপ্লবীরা ডাকাত এবং খারাপ। এই ধারণা যখন তার শিক্ষক অম্বিকা চক্রবর্তী পাল্টে দিলেন, তখন থেকে তিনি ব্রিটিশ বিরোধী সশস্র কর্মকান্ডের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন।
মাষ্টার দা সূর্য সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী যখন বন্দী তখন তিনি তাদের সাথে দেখা করেন। ক্রমশ তিনি বিপ্লবী ধারার দিকে ঝুকে পরেন। প্রথম বিভাগের ম্যাটিকুলেশনে উত্তির্ন হয়ে ঢাকা ইডেন কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী সংগঠন দীপালী সংঘের সাথে যুক্ত হয়ে যান। তার দাদাও ছিলেন মাষ্টার দা সূর্য সেনের সহকর্মী ও একজন অন্যতম বিপ্লবী। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতায় পরতে গিয়ে প্রীতিলতা যুক্ত হন বিপ্লবী সংগঠন ছাত্রি সংঘে। পরা শেষে চট্টগ্রামে ফিরে নন্দন কানন ইংরেজি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। মেধাবী শিক্ষক হিসেবে সর্ব মহলে পরিচিতি থাকলেও তার মন থাকত ব্রিটিশ খেদাও কর্মকান্ডের দিকে। সে তার দাদাকে বার বার অনুরোধ করতে থাকে, তাকে যে তাদের সংগঠনে নেয়া হয়। কিন্তু তখন বিপ্লবী সংগঠনে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল। প্রীতিলতার অনুরোধ ও আগ্রহ তার দাদা বিপ্লবী মাষ্টার দা সূর্য সেন কে জানালে তিনি সংগঠনের নিয়ম কিছুটা শিথিল করে কিছু নির্দেশনা দিয়ে প্রীতিলতা কে সংগঠনে যুক্ত করে নেন। প্রীতিলতা ও কয়েকজন নারী নানা কৌশলে সশস্র প্রশিক্ষণ নিতে থাকেন। মাষ্টার দার নির্দেশে তিনি সঙ্গী কল্পনা দত্তকে নিয়ে কলকাতা থেকে বিস্ফোরকের খোল সংগ্রহ করে আনেন। একটি একশনে দাদার মৃত্যু তাকে হতাস করলে মাষ্টার দা সূর্য সেন তাকে সাহসি করে তুলেন। কলকাতার আলিপুর জেলখানায় বন্ধি থাকা বিপ্লবী রাম কৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে তিনি ৪০ বার দেখা করেন। যা ছিল খুবি ঝুঁকিপূর্ণ। রাম কৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁশি হলে মাষ্টার দা সূর্যসেন আত্নগোপন করেন। সঙ্গঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন প্রীতিলতা ও অন্যান্যরা। ১৯৩২ সালের জুন মাসে চট্টগ্রামের ধল ঘাটে সাবিত্রী বিশ্বাসের বাড়িতে গপন বৈঠকে অবস্থান কালে পুলিশ বাড়িটি ঘেরাও করে ফেললে তারা সেখান থেকে কৌশলে সরে যান। এর পর মাষ্টার দা সূর্য সেন নারী বিপ্লবী দের কঠোর নির্দেশনা দিয়ে পটাশিয়াম সাইনাইড সর্বরাহ করে তা সব সময় সাথে রাখতে বলেন।
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বার প্রীতিলতা ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করলেন। এই দিন চট্টগ্রাম বাসীর অজান্তেই সংগঠনের নির্দেশনায় চট্টগ্রাম কাপিয়ে বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ইউরোপীয় ক্লাবের একশন করে বিজয়ী হয়ে ফেরার সময় লুকিয়ে থাকা এক ব্রিটিশের গুলিতে আহত হন। সংগঠনের নির্দেশ মত তিনি মনোবল না হারিয়ে জিবিত ধরা না দেবার জন্য সাথে থাকা পটাশিয়াম সাইনাইড পান করে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যক্রম কে বেগবান করলেন। সে সময় তাকে নিয়ে অনেক মন্তব্য প্রকাশ হয়। বিপ্লবী মাষ্টার দা সূর্য সেন বলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার একজন সাহসী, একনিষ্ঠ, মেধাবী, কর্তব্যপরায়ন ও বিপ্লবী নেত্রী। সে সময়কার সংবাদ পত্র গুলিও তাকে নিয়ে মন্তব্য প্রকাশ করেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার রানী সবকিছু উপেক্ষা করে নিজেকে উতসর্গ করে মায়ের সপ্ন পূরণে হয়ে গেলেন ইতিহাস।
লেখকঃ- ওয়ালিউর রহমান বাবু, সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মী, রাজশাহী।