শনিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
Logo
Waliur Rahman Babu

ছেলে বুলবুল ফিরে এলেও॥ ফিরেননি সাংবাদিক আবু সাঈদ

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশের সময়: ২৯ জুন, ২০২৪, ১১:৪৮এএম

ছেলে বুলবুল ফিরে এলেও॥ ফিরেননি সাংবাদিক আবু সাঈদ
ছেলে বুলবুল ফিরে এলেও॥ ফিরেননি সাংবাদিক আবু সাঈদ

১৯৭১ এর ২৮ জুন দুপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা মুক্তিকামী জনতাকে উজ্জীবিত করার অপরাধে স্বাধীনতাকামী, সাংবাদিক নাট্যব্যক্তিত্ব আবু সাঈদকে রাজশাহী জেলা সদরের ঘষ্টিতলা বাড়ি থেকে মিটিং এর নাম করে ধরে নিয়ে গেলে সাংবাদিক আবু সাঈদ আর ফিরেননি। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তিনি ছিলেন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর জন্ম হয়েছিল ঢাকার নরসিংদীর দইগাঁও গ্রামে। ১৯৪৯ সালে কৃষি দফতার চাকরি পেয়ে তিনি চলে আসেন রাজশাহীতে। চাকুরীর পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতে থাকেন । ছিলেন নাট্যশিল্পীও। সংবাদপত্র পড়তে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য নিজেই কখনো হেঁটে কখনো সাইকেলে সংবাদপত্র বিলি করতেন। রাজশাহী প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন । দৈনিক আজাদ ও ভারতের পশ্চিম বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত "লোকসেবক' এর রাজশাহী প্রতিনিধি ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় তিনি ঢাকায় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজশাহী সাংস্কৃতিক সংঘ ও পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি একজন। রাজশাহীর নাট্যব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। টিপু সুলতান, নবাব সিরাজউদ্দৌলাহ, মাটির ঘর এরকম নাম করা নাটকে অভিনয় করে দারুণ পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। পাকিস্তন আর্ট কাউন্সিল রাজশাহী শাখা সম্পাদক ছিলেন। সম্পৃক্ত ছিলেন রাজশাহী বেতারের সঙ্গেও। অনেকের কাছ থেকে জানা যায় ১৯৬৯ এর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সময় তিনি তার লেখনিকে শক্তিশালী করেন। রাজশাহী জেলা সদরের গোরহাঙ্গায় তার "দৈনিক আজাদ" সংবাদপত্র অফিসটি সকলের সংবাদ পাঠের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। কারণ সে সময় অতি সহজে রাজধানী ঢাকা ও অন্যানা অঞ্চলের সংবাদ পাওয়া ছিল খুবই দুরুহ ব্যাপার।

১৯৭১ এর ১ মার্চ থেকে স্বাধীনতার দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠে রাজশাহী। রাজশাহীতে অসহযোগ আন্দোলন- প্রতিরোধের প্রস্তুতি শুরু হলে তিনি সাংবাদিক, শিল্পী, সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা রাখতে থাকেন। সে সময় তিনি পরিবার পরিজনদের নিয়ে থাকতেন রাজশাহী পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন টিবুল এস্টেট কলোনিতে। এখানে থাকা পাকিস্তানপন্থীদের রোষানলে পড়েও তিনি কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে তার কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। পারিবারিক সূত্রে জানা যায় অনেকে তাকে সীমান্ত পার হতে বললে তিনি দেশ ছাড়তে রাজী হননি। পরিস্থিতির কারনে তিনি পরিবার পরিজনদের নিয়ে রাজশাহী জেলা সদর থেকে পূর্বদিকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পুঠিয়ায় আশ্রয় নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী শহর দখল করে নিলে পাকিস্তানপন্থী অবাঙালিরা তার বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেয়। কিছুদিন পর শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিন নানা কথা বলে পুঠিয়া থেকে তাকে ও তার পরিবারের সকলকে রাজশাহীতে নিয়ে এলে তিনি হলো রাজশাহী জেলা সদরের ষষ্টিতলা এলাকায় অবস্থান নেন। ২৮ জুন দুপুরে তিনি যখন বাড়িতে ভাত খাচ্ছিলেন তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সেখানে গিয়ে তার স্ত্রী শামসুন নাহারকে জিজ্ঞাসা করে আবু সাঈদ আছে কি ইউনিভার্সিটিতে মিটিং আছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ভাত খেতে না দিয়ে আবু সাঈদকে ধরে নিয়ে গেল। পরের দিন ২৯ জুন সকালে পাকিস্তনি সৈন্যরা তাদের বাড়ি থেকে তার ছেলে বুলবুলকেও ধরে নিয়ে যায়। সাংবাদিক শহীদ আবু সাঈদের স্ত্রী শামসুন নাহার তার স্মৃতিচারণ থেকে বলেন, স্বামী আবু সাঈদ ফিরে না আসায় এবং পরের দিন ছেলে বুলবুলকে ধরে নিয়ে গেলে তিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করলে আয়েন উদ্দিন তাকে জানায় ব্যাপারটি উনি দেখছেন। কিন্তু তার মনে  সন্দেহের সৃষ্টি হলে তিনি জামায়াতে ইসলামি করা সেই সময়কার প্রভাবশালী পাকিস্তনি সৈন্যদের দোসর সাংবাদিক আল-আমিনকে নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে স্বামী সাংবাদিক আবু সাঈদকে খুঁজতে গিয়ে বার্থ হয়ে ফিরেন। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আয়েন উদ্দিন তাকে বলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা ছেড়ে দিবে। সন্ধার সময় ছেলে বুলবুল ফিরে এলেও তিনি ফিরেননি। ছেলে বুলবুল স্মৃতিচারণ থেকে জানান পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে বাড়ি থেকে ধরে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় জোহা হল ক্যাম্পে নিয়ে যাবার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী অফিসাররা উর্দুতে তার বাবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি উর্দুতে তাদের জানান তার বাবা আওয়ামী লীগ করেন না কোন কিছু করেন না। এসময় অফিসাররা একটি ফাইল বের করে সভা মিছিলের ছবিতে কালো ব্যাচ পড়া তার বাবাকে দেখিয়ে বলে তাহলে এটা কে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি। তারা তাকে দুপুরে গোস্ত রুটি খেতে দেয় এ সময় তিনি শুনতে পেলেন পাশের ঘর থেকে আসা ভয়াবহ চিৎকার। বুঝে ফেললেন নির্যাতন চলছে। তাকেও এভাবে নির্যাতন করা হবে ভেবে নিয়ে বাবাকে দেখা যায় কিনা তার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক বালুচ অফিসার তাকে বলেন তিনি চেষ্টা করছেন এ বালুচ অফিসারটি কৌশলে নিজ জিম্মায় বুলবুলকে রাজশাহী জেলা সদর বোয়ালিয়া থানায় এনে ছেরে দিলে তিনি সন্ধ্যার দিকে বালি বাড়ি ফিরলেও ফিরেননি তাদের বাবা সাংবাদিক আবু সাঈদ। বুলবুল সীমান্ত পার হলেন।

সাংবাদিক আবু সাঈদের মেয়ে লাকি তখন খুবই ছোট, স্মৃতিচারণ থেকে জানান তারা  অভিভাবকহীন হয়ে পরলে ঘনিষ্ঠজনেরা সহযোগিতা দিতে থাকেন। পাকিস্তান সৈনাদের দোসর অবাঙালি আমজাদ অস্ত্র নিয়ে বুকে গুলির বেল্ট লাগিয়ে তাদের বাড়িতে এসে নানা কথা জানার চেষ্টা করতে থাকলে তাদের মা তা বুঝে আমজাদকে এড়িয়ে যেতে থাকেন। বোনেরা গণকপাড়ায় ধর্মচাচা সোনায় বাড়িতে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাবা হারানোর দুঃখ-কষ্টকে তারা সাঁপ দিলেন সবুজের উপর লালবৃত্তের পতাকায়। গর্বিত হলেন তাদের বাবার জীবন উৎসর্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকের লাশ পাওয়া গিয়েছে সেখানে গেলে সাংবাদিক শহীদ আবু সাঈদের লাশ পাওয়া যাবে এই তথ্য পেয়ে তার মা শামসুন নাহার সেখানে গিয়ে খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হন। পাকিস্তানি সৈনাদের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া একজনের দেয়া তথ্যে তারা জানতে পান পাকিস্তানি সৈন্যরা ৫ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় রেললাইনের ধারে সাংবাদিক আবু সাঈদকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়। সংবাদপত্র থেকেও তারা এ তথ্য পান। 

ভাষা সৈনিক একরামুল হক, ভাষা সৈনিক সিনিয়র সাংবাদিক আবু সাঈদ উদ্দিন আহমেদ, নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন, নাম করা আলোকচিত্রী মোতাহার হোসেন নানাভাবে এই পরিবারকে সহযোগিতা করতে থাকেন । জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের আর্থিক সহযোগিতা দেন। তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভার চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান শহীদ আবু সাঈদের স্ত্রীর সামসুন নাহারকে চাকরির সুযোগ করে দেন । পৌরসভা কর্তৃপক্ষ তার স্মরণে রাজশাহী জেলা সদরের একটি রাস্তার নামকরণ করেন। ১৯৯৫ সালে ডাকবিভাগ তার প্রতিকৃতি সম্বলিত ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ভাষাসৈনিক সিনিয়র সাংবাদিক সাইদ উদ্দিন আহমেদ জানান শহীদ আবু সাইদ রাজশাহী প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন নিষ্ঠাবান, নির্ভীক সাংবাদিক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্টার সে সময়কার সাংবাদিক আহমেদ সাফিউদ্দিন জানান তিনি ও সাংবাদিক মরহুম মঞ্জুরুল হক এই পরিবারটির খোঁজখবর রাখতেন। মরহুম মঞ্জুরুল হকের সঙ্গে শহীদ আবু সাইদের নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। তিনি বেঁচে থাকলে শহীদ আবু সাইদ সম্পর্কে অনেক মূল্যবান কিছু জানা যেত। সাংস্কৃতিক কর্মীরা রাজশাহী পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের সামনে উন্মুক্ত মঞ্চটি শহীদ আবু সাইদের নামে নামকরণ করে। মঞ্চটি এখন আর নেই। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ তার সন্তানকে চাকরির সুযোগ করে দেন। রাজশাহী সংবাদ পত্র দৈনিক নতুন প্রভাত তাকে মরণোত্তর প্রদান করেছেন। 

লেখক: মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী।