রাজশাহী শহরের শব্দদূষণের বিপজ্জনক মাত্রা নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল তথা রাজশাহীর উন্নয়ন গবেষণাধর্মী পরিবেশবাদী যুব ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। প্রতিদিন শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো যেমন সাহেববাজার, তালাইমারি, রেলগেট, রেলওয়ে স্টেশন চত্বও ঢাকা বাস টার্মিনাল, ভদ্রা মোড় ও লক্ষ্মীপুরে শব্দের মাত্রা আইনসিদ্ধ সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে, যা নগরবাসীর দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (টঘঊচ) ২০২২ সালের রিপোর্টে রাজশাহীকে বিশ্বের চতুর্থ শব্দদূষণকারী শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা নগর জীবনের জন্য এক গভীর সংকেত।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রথম আলো, প্রতিদিনের বাংলাদেশ, আজকের পত্রিকা সহ স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা গেছে যে, শব্দ দূষণ বাড়ছে রাজশাহীতে। রাজশাহীতে সর্বোচ্চ শব্দ ৯৬.৩০ ডেসিবেল । শিল্প এলাকা ছাড়া রাজশাহী শহরের সর্বত্র তীব্র শব্দদূষণ। বরেন্দ্র পরিবেশ স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা নামে একটি বেসরকারি সংগঠন গত তিন বছর ধরে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি মোড়ে শব্দদূষণেন মাত্রা পরিমাপ করে আসছে। সংগঠনটির তথ্য মতে, ২০২২ সালে রুয়েট সংলগ্ন তালাইমারি মোড়ে শব্দের গড় মাত্রা নির্ণয় করা হয় ৮৪ ডেসিবল, ২০২৪ সালে ৮৮.৮০ ডেসিবল। হাসপাতাল এলাকা লক্ষ্মীপুর মোড়ে ২০২২ সালে ছিল ৯০ আর ২০২৪ সালে ছিল ৯৬.১০ ডেসিবল। সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে ২০২২ সালে ছিল ৮৮ এবং ২০২৪ সালে ৯০.৫০ ডেসিবল। রেলগেট এলাকায় ২০২২ সালে শব্দের মাত্রা ছিল ৯০ ডেসিবল, ২০২৪ সালে তা হয় ৯৬.৩০। এ ছাড়া রাজশাহীর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা হিসেবে পরিচিত বিসিক শিল্প নগরীতেও শব্দের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
শব্দদূষণের প্রভাব
১. স্বাস্থ্যগত ক্ষতি: অতিরিক্ত শব্দ দীর্ঘমেয়াদে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট করার পাশাপাশি, মানসিক চাপ, অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের মতো গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করছে। বিশেষত, ট্রাফিক পুলিশসহ যেসব পেশাদার প্রতিনিয়ত উচ্চমাত্রার শব্দের সম্মুখীন হন, তাদের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ট্রাফিক সার্জেন্ট আ. কাইয়ুমের মতে, রাস্তায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে এবং শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২. শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার ওপর প্রভাব: শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসগুলোর আশেপাশে উচ্চমাত্রার শব্দদূষণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ নষ্ট করছে এবং কর্মীদের কাজের সক্ষমতা কমাচ্ছে। ক্রমাগত শব্দের মধ্যে থাকলে শিক্ষার মান ও কর্মক্ষমতা উভয়ই হ্রাস পায়।
৩. প্রাণিজগতের ওপর প্রভাব: শব্দদূষণের প্রভাবে কেবল মানুষই নয়, প্রাণীজগতও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। শহরের পাখি ও অন্যান্য প্রাণী তাদের খাদ্য সংগ্রহ, প্রজনন এবং বাসস্থান গঠনে বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।
শব্দদূষণের কারণ ও বর্তমান পরিস্থিতি
রাজশাহী শহরে শব্দদূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যা বৃদ্ধি, হাইড্রলিক হর্নের ব্যাপক ব্যবহার এবং নগরায়নের নামে বৃক্ষনিধন। রাজশাহীর রেলগেট, তালাইমারি ও সাহেববাজার এলাকার শব্দের মাত্রা ইতিমধ্যে ৯০-৯৬ ডেসিবলের উপরে চলে গেছে, যেখানে আইনসিদ্ধ সীমা হলো ৭০ ডেসিবল। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে তালাইমারিতে শব্দের গড় মাত্রা বেড়ে ৮৮.৮০ ডেসিবল হয়েছে। এটি স্বাভাবিক জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১. রাজশাহীতে দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, নাগরিক স্বাস্থ্য হুমকির মুখে: রাজশাহী শহরে ক্রমবর্ধমান শব্দদূষণ নগরবাসীর মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। নগর উন্নয়ন কার্যক্রম এবং যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার শহরের শব্দদূষণের মূল কারণ। বিশেষ করে প্রধান প্রধান মোড়ে হর্নের আওয়াজ, কনস্ট্রাকশনের শব্দ, এবং বৃক্ষনিধনের ফলে পরিবেশ দূষণ আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিচ্ছেন শহরে শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবুজায়নের উদ্যোগ নিতে।
২. শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে শব্দদূষণ : রাজশাহীর শব্দদূষণের মাত্রা শিশুদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শহরের স্কুল, খেলার মাঠ, এবং আবাসিক এলাকাগুলোর কাছাকাছি অস্বাভাবিক উচ্চমাত্রার শব্দ শিশুদের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। এতে করে তাদের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, যা শিক্ষাজীবনে প্রভাব ফেলছে। শিশু বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যা সমাধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর চারপাশে বৃক্ষরোপণ এবং হর্নের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
৩. যানজট এবং হর্নের ব্যবহার শব্দদূষণকে বাড়াচ্ছে : রাজশাহীতে যানজট এবং অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানোর প্রবণতা শহরের শব্দদূষণকে আরও তীব্র করছে। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলোর উচ্চ মাত্রার হর্ন এবং রাস্তায় যানজটের কারণে বাজানো হর্ন শহরের পরিবেশকে বিষাক্ত করে তুলছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে, যানবাহন ব্যবস্থাপনা এবং হর্ন নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক পুলিশের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
৪. রাজশাহীর শব্দদূষণের প্রভাব শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে : শব্দদূষণের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পরীক্ষার সময় কিংবা পড়ার সময় উচ্চমাত্রার শব্দ তাদের পড়ার পরিবেশকে ব্যাহত করছে, ফলে শিক্ষার গুণগত মানেও প্রভাব পড়ছে। শব্দদূষণ থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করার জন্য আবাসিক এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এলাকায় হর্নের ব্যবহার বন্ধ করা এবং নীরবতা নিশ্চিত করতে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
৫. বৃক্ষরোপণ শব্দদূষণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ : রাজশাহীর শব্দদূষণ কমাতে বৃহৎ পরিসরে বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। বৃক্ষগুলো শব্দ শোষণ করতে সক্ষম হওয়ায় শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর পাশে বেশি করে গাছ লাগানোর প্রস্তাবনা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় সবুজায়নের অংশ হিসেবে শহরের ফাঁকা জায়গাগুলোতে বনায়ন করার মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
প্রস্তাবিত কার্যকর পদক্ষেপ:
শব্দদূষণের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবেলায় ইয়্যাস থেকে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাবনা তুলে ধরা হচ্ছে:
১. হর্নের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ: উচ্চমাত্রার হর্নের পরিবর্তে সাইলেন্ট হর্ন বা ভেঁপু হর্ন বাধ্যতামূলক করা উচিত। এই পদক্ষেপ অবিলম্বে শব্দদূষণের মাত্রা হ্রাস করতে সহায়ক হবে।
২. ব্যাটারিচালিত যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: শহরের নির্দিষ্ট অংশে ব্যাটারিচালিত যানবাহনের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা হলে যানজট ও শব্দদূষণ কমানো সম্ভব হবে। এটি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নেও সহায়ক হবে।
৩. বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম জোরদার করা: শহরের প্রান্তিক এলাকায় বেশি করে বৃক্ষরোপণ করা হলে শব্দের শোষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। বিশেষ করে আম, নিম, সজনে প্রভৃতি গাছ শহরের শব্দ শোষণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: মানুষকে অপ্রয়োজনীয় হর্ন বাজানো থেকে বিরত রাখতে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো জরুরি। পাশাপাশি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে 'শব্দদূষণমুক্ত অঞ্চল' চিহ্নিত করা এবং এই বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি সহযোগিতা:
নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবহন মালিক সমিতির সহযোগিতায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং নগর পরিকল্পনার আওতায় পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ (ইয়্যাস) এর পক্ষ থেকে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শব্দদূষণের এই সংকট কাটিয়ে উঠা সম্ভব। আমরা "তারুণ্যের জয় হবে নিশ্চয়ই" স্লোগানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আজকের পদক্ষেপ আগামী প্রজন্মের জন্য সুস্থ ও স্থিতিশীল নগর জীবনের প্রতিশ্রুতি। রাজশাহীর সবার অংশগ্রহণ ও সচেতনতা একত্রে আমাদের শহরকে শব্দদূষণের বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারবে। চলুন, সচেতন হই এবং নগরজীবনে পরিবেশবান্ধব ও নীরবতার সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে একযোগে কাজ করি।
ই-চিঠি: md.shamiulalimshawon@gmail.com