১৯৭১ সালের ১৫/১৬ নভেম্বর ঈদের সকাল চলছে মুক্তিযুদ্ধ। ৭ নং সেক্টরের চাঁপাইনবানগঞ্জ মহকুমার মুক্ত অঞ্চল ৩ নং মহদী পুর সাব সেক্টরের বালিয়াদিঘী ক্যাম্পের মুক্তি যোদ্ধারা কেউ পুকুরে সাতার কাটছেন কেউ স্মৃতি চারন করছেন, এমন সময় খবর দেয়া হল যরুরী নির্দেশনা আছে । দুপুরে একটু ভালো খাবার খেয়ে ‘বি’, ‘সি’, ‘ডি’ কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা বালিয়াদিঘী ডাক বাংলো ক্যাম্পে একত্রিত হলেন । সেখানে গিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কাজী নূরুজ্জামান (বীর উত্তম), বীর মুক্তিযোদ্ধা লাল গোলা ৪ নং সাব সেক্টর বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী ( বীর বিক্রম )।
আগে থেকেই সেখানে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর শ্রেষ্ঠ মহদীপুর ৩ নং সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কাইউম। সকলে ফলিং করার পর সেক্টর কমান্ডার সকলকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে পাকিস্তানি সন্যদের আক্রমন পতিরোধে বলেন সেদিনের অ্যাকশনটি হবে ‘অ্যাডভান্স টু কানসার্ট ’ সরাসরি অ্যাকশন । মেজর গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী চাঁপাইনবানগঞ্জ মহকুমার ম্যাপ মাটিতে রেখে সবকিছু ব্রিফিং করে পোশাক কি হবে জানিয়ে বলেন এ অ্যাকশনে নেতৃত্ব দিতে তিনি লালগোলা থেকে সেখানে গেছেন ।
বিকেল ৪ টা। লুঙ্গি শার্ট সুয়েটার মাথায় গামছা বেঁধে সকলে প্রস্তুত হলেন । লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম ‘বি’ কোম্পানি নিয়ে বাম
পাশের গ্রামের মধ্য দিয়ে, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে ডান পাশের গ্রামের মধ্য দিয়ে অ্যাডভান্স হলেন । মেজর গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর ‘ডি’ কোম্পানী নিয়ে সোনা মসজিদ পার হয়ে সরাসরি অ্যাডভান্স হয়ে ৫০০ গজ দুরে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবজার্ভেশন ক্যাম্পের কাছে পৌছালেন । পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থক দের দবরা গ্রামের ক্যাম্পের পরেই কলাবাড়ি তে পাকিস্থানি সৈন্যদের বড় ক্যাম্প । স্লোগান, গুলির প্রতি উত্তর না পেয়ে এক গ্রামবাসির মাধ্যমে জানা গেল পাকিস্তানি সৈন্যরা আমবাগানে আছে । সকলে এ্যাসাল্ট হতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাস ফায়ার করতে থাকে অ্যাকশন শুরু হয়ে গেল। ডান পাশ থেকে স্লোগান শুনে সকলে ভাবে ‘সি’ কোম্পানি অ্যাডভান্স করছে কিন্তু দোয়া দরূদ ঘাবরাও মাত শুনে ভুল ভেঙ্গে গেল । সেদিন ই তরঙ্গপুর হেডকুয়াটার থেকে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা পাবনার কবির চিৎকার করে জানান তিনি গুলি বিদ্ধ হয়েছেন । বীর মুক্তিযোদ্ধা কাউসারের অ্যাকশনের অভিঙ্গতা না থাকাই তিনি রানার বীর মুক্তি যোদ্ধা রবিউল ইসলাম কে বিষয় টি জানিয়ে পেছনে গেলেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের ফায়ারে বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম খালের পাড়ে পড়ে গেলেন । জ্ঞান ফিরলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেনের কাছে জানলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এল এম জি মেন শহিদ হয়েছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শের মোহাম্মদ মৃত দেহটি ঘাড়ে তুলে নিলে রবিউল ইসলাম তাকে সহযোগিতা দিতে থাকেন । এক বাড়ির বাঁশের দরজা খুলে তার উপর আহত কবীর কে তুলে নেয়া হল । পাকিস্তানি সৈন্যরা মটার ছুড়তে থাকে। মেজর গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী কয়েক জন কমান্ডারের সাথে পরামর্শ করে হাটতে না পেরে খোড়াতে থাকেন। ওয়ারলেস বিচ্ছিন্ন থাকায় ‘বি’ ও ‘সি’ কোম্পানির কোন খবর পাওয়া গেল না । রানার এসে জানায় লেফটেন্যান্ট কাইউম গুলি বিদ্ধ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও তার কোম্পানি অল্পের জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের ফাঁদ থেকে রক্ষা পেলেও তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। মেজর গিয়াস উদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর অনিচ্ছা সত্তেও তাকে জোর করে ঘাড়ে তলে নিরাপদ স্থানে পৌছিয়ে দুই মাইল পেছনে থাকা একটা গাড়িতে শহিদ এল এম জি ম্যানের মৃত দেহ তোলা হল । লেফটেন্যান্ট কাইউম তার বাহিনী নিয়ে ফিরে এলেও ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও তার বাহিনী ফিরে না এলে সকলে চিন্তিত হয়ে পড়ে । ক্যাম্পে ফিরে বীর মুক্তিযোদ্ধা বুঝতে পারেন শহিদ সঙ্গীর রক্তে তার শার্ট, সুয়েটার ভিজে গেছে। রক্তের গন্ধ অনুভব করেন । গভীর রাতে বিধস্ত অবস্থায় ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ও তার বাহিনী নিযে ক্যাম্পে ফিরে এলেন। আজও প্রতি ঈদের দীন বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম শহিদ সঙ্গীর সেই তাজা রক্তের গন্ধ অনুভব করে তন্ময় হয়ে যান। {তথ্য সুত্রঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল ইসলাম}
লেখক তথ্য সংগ্রাহক রাজশাহী