পাকিস্তানি সৈন্যরা নাজেহাল হয়ে ও স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের মেধাশূন্য করতে তাদের সমর্থকদের সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় ২৫ নভেম্বর রাতে রাজশাহী জেলা সদরের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর একদড়িতে বেঁধে জীবন্ত অবস্থায় শ্রীরামপুর পদ্মানদীর চরে পুতে দেয়। তারা ফিরে না আসায় এই তারিখটি তাদের হত্যা দিবস পালন করা হয়। জানা যায় ব্যবসায়ি আজিজুল হক চৌধুরীকে ধরার জন্য তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে এসে তার ম্যানেজার কে ধরে নিয়ে যায়। তিনি রক্ষা পেয়ে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর পাকিস্থানি সৈন্যরা আবার সেখানে এসে আজিজুল হক চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম চৌধুরী খুরশিদ বিন আলমের দেয়া তথ্যে জানা যায়, শান্তি কমিটির দুই প্রভাবশালী নেতার ক্ষমতার দ্বন্ধে এই হত্যাকান্ড চালানো হয়। বিজয় অর্জনের পর একজনকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আরেকজন গ্রেপ্তার হয়ে মুক্তি পায়। কিন্তু তার কাছ থেকে এই হত্যাকান্ডের তথ্য বের করতে কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।হাবিবুর রহমান দুলু নামে একজনের দেয়া তথ্যে জানা যায়, তার মামা ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস(ই পি আর)এর সদস্য বীর মুক্তি যোদ্ধা মুক্তা পরিবারের সাথে দেখা করতে এলে পাঠানপাড়ার লুলু কাঠ মিস্ত্রি তাকে ধরিয়ে দেয়। তার মৃত দেহ শ্রীরামপুর বদ্ধভুমি থেকে অন্যদের সাথে একইদিন তোলা হয়। বিজয় লাভের পর ৩০/৩১ ডিসেম্বর এক ব্যক্তি শ্রীরামপুর পদ্মার চরে একটি মৃত দেহের অংশ দেখতে পেলে খবরটি ছড়িয়ে পরে। শহিদদের স্বজনরা পোশাক, চশমা, আংটি ইত্যাদি দেখে মৃত দেহ শনাক্ত করেন।কারো মতে সতেরো কারো মতে আঠারোটি মৃত দেহ পাওয়া যায়। সবার নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি।এই রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মীর আব্দুল কাইয়ুম কে ঘোড়ামারাস্থ তার শ্বশুর বাড়ি থেকে ডেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবাঙালি স্টেনোগ্রাফার আবু তৈয়ব পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে ধরিয়ে দেয়।{তথ্যসুত্রঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহমেদ খান সাবেক কিউরেটার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি যাদুঘর, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয় ও শহিদের স্বজন} এই অবাঙালি আবু তৈয়ব জানায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ক্যাপ্টেন স্যার (শহিদ মীর আব্দুল কাইয়ুম)কে কথা বলার নাম করে নিয়ে যায়।{তথ্যসুত্রঃ “শহিদ মীর আব্দুল কাইয়ুম-মানবতার প্রতীক” অরুন বসাক, পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ২১ নভেম্বর, ২০২১}শোনা যায় এই আবু তৈয়ব চাকুরীতে বহাল থাকে তবে সে কর্তৃপক্ষের কাছে কি তথ্য দেয় তা অস্পষ্ট।শহিদদের মৃত দেহ তোলার সময় উপস্থিত ছিলেন শহিদ স্বজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান খান আলম, তার মামা হাফিজ উদ্দিন, প্রতিবেশী আব্দুল মজিদ। শহিদ স্বজন তৈফিকুর রহমান লাবলু, সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন, শহিদ স্বজন আসাফুদ্দৌলা খান গুলজার প্রমুখ। তারা জানান সঠিক প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়ায়, ঘটনা সম্পর্কে জানা অনেকে মুখোশ পাল্টিয়ে ফেলায় এবং অনেকে সরে পরায় ঘটনাটি চাপা পড়তে থাকে। সে সময় প্রচুর বন্যা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা অস্ত্র সংকটে তাদের কৌশল পাল্টিয়ে ধরে নিয়ে যাওয়াদের নির্যাতন করার পর পদ্মা নদীর চরে পুতে বা নদীতে ফেলে দিত। বলা যেতে পারে, পদ্মা নদীর চর এবং চর ঘেষে পদ্মা নদী বধ্যভূমি।রাজশাহী ইতিহাস সংরক্ষণ পরিষদ, ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে শ্রীরামপুর পদ্মা নদীর চর বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানায়।১৯৯৫ সালে সাবেক সিটি মেয়র মিজানুর রহমান মিনু এখানে স্মৃতি ফলক স্থাপনের উদ্যোগ নেন।১৯৯৫ সালের ২৫ নভেম্বর ফলকটি উন্মোচন করেন শহিদ মীর আব্দুল কাইয়ুমের পত্নী অধ্যাপক মাসতুরা খানম। অভিনেতা আসাদুজ্জামান নুর(সাবেক মন্ত্রী)ও ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিনিধি এখানকার মাটি সংগ্রহ করেন। দাবী উঠে স্মৃতি সৌধ নির্মানের।সাবেক সিটি মেয়র, সাবেক সাংসদ দ্বয়, বিভিন্ন স্তরের মানুষ এই দাবীর সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। স্মৃতি সৌধ নির্মানের উদ্যোগ নেয়া হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এর সহযোগিতায় এখানে স্মৃতি সৌধ নির্মান করেছে।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রেস ক্লাব ও জননেতা আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ দিনটি পালন করে।স্মৃতি সৌধ চত্তরে অনেক জায়গা থাকলেও প্রথম স্মৃতি ফলকটি একটি বাড়ির রান্না ঘরে রেখে প্রাচির দিয়ে আড়াল করায় না না প্রশ্ন উঠে।২০২৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা পক্ষথেকে প্রথম স্মৃতি ফলকটি বধ্যভূমি গেটে স্থাপন করা হয়। এই বধ্যভূমি থেকে নাম জানা যে শহিদদের মৃত দেহ তোলা হয় তারা হলেন- শহিদ আজিজুল হক চৌধুরী, শহিদ মকবুল হক চৌধুরী, শহিদ মীর আব্দুল কাইয়ুম, শহিদ আলতাব হোসেন, চেয়ারম্যান শহিদ আলাউদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তা, শহিদ নওরোজ দৌল্লা খান, শহিদ তৈয়ব আলী। শহিদ পরিবারের অভিযোগ এই হত্যাকান্ডের সাথে জরিত থাকা পরিবার মুখোশ পাল্টিয়ে ফুলে ফেপে বহাল তবিয়তে আছে। দাবী এ হত্যাকান্ডের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করে দায় দের চিহ্নিত করা হোক।