একদিন দুপুরে পার্বতীপুর থেকে রাজশাহী ফেরার পথে আব্দুরপুর রেলওয়ে স্টেশনে খাবার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হকের সাথে পরিচয় হয়। প্রচার বিমুখ শামসুল হককে অনেক অনুরোধ করার পর তিনি তার জীবনের সেই দুঃসাহসিক
ঘটনার কথা জানান। ১৯৬৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি হক যোগ দিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। তাকে সহ আরো কয়েকজনকে ঢাকা থেকে নিয়ে যাওয়া হল পশ্চিম ত্য পাকিস্তানের কোয়াটে। সিরিয়ালে সিনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তাদের ছেচল্লিশজনকে সব শেষে রাখা হলে একজন বাঙালি অফিসার বিষয়টি বুঝতে পেরে শামসুল হকদের বলেন নাম সিরিয়ালের আগে থাকলে প্রমোশনের সময় সিনিয়রটি আগে পাওয়া যায়। এই বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে শামসুল হক স্কোয়াড কমান্ডার মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার গারভেজিকে বলেন, তাদের নাম সব শেষে কেন এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গারভেজি তাকে গালি দিয়ে বলে, “ইউ ন্যুডি চ্যাপ ডট ডু মিউটিনি” এই গালি শোনার পর শামসুল হকের মন বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। বুঝতে পারলেন বাঙালিদের প্রতি অবাঙালিদের বৈষম্যমূলক আচরণ। ট্রেনিং শেষে ট্রেড বন্টনের ক্ষেত্রে বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে বৈষম্য আচরণ করা হল। তাকে দেওয়া ট্রেড এমটিএফ (ম্যাকানিক্যাল ট্রান্স পোর্ট ম্যাকানিক)। তার পছন্দ না হলেও এখানে তিনি সফল হলেন। ট্রেনিং শেষে যোগ দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মাশরু ইয়ার বেসে। অ্যাডভান্স ট্রেনিং শেষে তাকে বিভিন্ন জায়গায় ডেপুটেশনে পাঠানো হয়। উনিশশো সত্তর সনে পশ্চিম পাকিস্তানের বেদিনে কর্মরত থাকা অবস্থায় ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের অবজারভার ইউনিটকে সিন্ধু প্রদেশের রাজস্থানের সীমান্তের কাছে ওমর কোট, ইসলাম কোট অঞ্চলে এক্সেসাইজে পাঠান হয়। উনিশশো একাত্তর সনের মার্চ মাসে তাদের ইউনিটকে ওমর কোর্টে ছিল। গভীর রাতে সঙ্গী ফরিদপুরের মহসীনের কাছে জানতে পারলেন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকাতে পাকিস্তানি সৈন্যর। বহুজনকে হত্যা করেছে। কথাটি সত্য হলো। সকাল হবার সঙ্গে সাঙ্গ তাদের ইউনিটকে বেসে ফেরত পাঠানোর জন্য তাড়াহুড়া শুরু হয়ে গেল। যদিও এভাবে এক্সেসাইজে থাকা কোনো ইউনিটকে ফেরত আনা হয় না। ইউনিটটিকে বেদিন বেসে ফেরত এনে শুরু হল খারাপ আচরণ করা হল। তাদের ডিস আর্মের পর নজরবন্দি করা হল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যাওয়া অবাঙালি সৈনিকেরা বেশি খারাপ আচরণ করতে থাকে। শামসুল হকদের পৃথক করে, পৃথক ব্যারাকে রাখা হলে তারা বুঝে ফেলেন পূর্ব পাকিস্তানে কিছু ঘটেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন এভাবে জীবন না দিয়ে কৌশলে এখান থেকে বেরিখে যেতে হবে। অন্যান্য বাঙালিদের সহযোগিতায় বেসের বাইরে অবস্থানরত পরিবার নিয়ে বসবাসরত সার্জেন্ট আরেফিনের সঙ্গে তার বাড়িতে সঙ্গী মহসীনকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে গিয়ে, দেখা পেলেন সেখানে অপেক্ষা করা কয়েকজন বাঙালি এয়ারম্যানের। সিদ্ধান্ত হল তারা দুইজন ওই রাতে সীমান্ত পার হবেন কারণ তারা
দুজনেই এ রাস্তা চেনেন। তাদের দেয়া হল একটা নকশা ও বেদিন রাডারের কাগজের অনুলিপি। বিদায় নিয়ে শুরু হল তাদের দুঃসাহসিক যাত্রা। রানআপ কোচের দিকে তারা এগুতে থাকেন তাদের সঙ্গে কিছু টাকা আছে। বলে দেয়া হল গুদ্দু ব্যারেজের
আশেপাশে বহু বাঙালি পরিবার আছে তাদের একজন খন্দকার সাহেব, তিনি সহযোগিতা দেবেন। বেদিন বেস থেকে ওই অঞ্চলটি আঠারো কিলোমিটার দূরে। ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে নিয়েও অসমতল কংকরযুক্ত কাচা রাস্তা দিয়ে
তারা দৌড়াতে থাকেন। কোনো গাড়ি আসলেই গর্তের মধ্যে শুয়ে পড়তে থাকেন। এক বাঙালি খুব ভোরে তাদের খন্দকার সাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। খন্দকার সাহেব নামে ব্যক্তিটি তাদের আশ্রয় দিয়ে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। সীমান্ত পার হওয়া নিয়ে আলোচনা হল। ব্যবস্থা হল খাবারের আনা হল সিন্ধি পোশাক ও উট। তারা পড়ে নিলেন ওই পোশাক। চালকসহ তারা দুইজন উঠে বসে চলতে শুরু করলেন । রানআপ কোচের দিকে যেতে থাকেন। সীমান্ত পার হতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন ওপিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে।
সেখান থেকে সরে অন্যদিক দিয়ে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। যেদিকে চেষ্টা করছেন সেদিকে মাস ল্যান্ড। উট নিয়ে পার হওয়া গেল না। ফিরে এলেন আশ্রয় দেয়া ফন্দকার সাহেবের বাড়ি। সামনে বিপদ জেনেও অপেক্ষা করতে থাকেন। সিদ্ধান্ত নেন বেদিন ফিরে সোর রেল স্টেশন দিয়ে মনোয়া সীমান্ত পার হবেন। অনেক রাস্তা হায়দ্রাবাদ হয়ে যেতে হবে। সিন্ধি পোশাক পরে হায়দ্রাবাদ থেকে পায়ে হেঁটে রওনা মরুভূমির দিকে রওনা দিলেন। অনেক কষ্টে নয়দিন পর রাত তিনটায় পৌঁছান সোর রেলওয়ে স্টেশনে। ওপারে ভারত। মনোয়া রেল স্টেশনে সরাসরি না গিয়ে ডিউডুইন পার হয়ে ভারতীয় সীমান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করলেন। প্রচণ্ড অন্ধকার চিন্তা-ভাবনা করে এগুচ্ছেন। ভারতীয় অঞ্চলের আলো দেখতে পেলেন। একটা ডিউডুইনে উঠতেই হঠাৎ তাদের ওপর বজ্রপাত হলে চমকে উঠেন। একজন চিৎকার করে বললো, “হোল্ড ডন্ট মুভ” শামসুল হক তার কাছে থাকা কাগজ নকশা অস্ত্র নিয়ে শুয়ে পরে এগুলো বালির মধ্যে পুঁতে ফেললেন । বুঝে ফেললেন তারা বন্দি হয়ে গেছেন। অফিসাররা ভালো আচরণ করলেও তারা বুঝে ফেললেন তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে। সকাল দশটার দিকে বেদিন বেস থেকে আসা সামরিক গাড়িতে তাদের তুলে দেয়া হলে দেখতে পেলেন গাড়ির চালক অবাঙালি সঙ্গী জহুরকে। তাদের চোখ বেঁধে ফেলা হল। চালক জহুর শামসুল হককে বলে পালাচ্ছিলে কেন? এর উত্তরে তিনি সাহস নিয়ে বলেন “লেট মি লিভ ইন পিস ডন্ট আসক মি এনিথিং”। তাদের উপর শুরু হল শারীরিক নির্যাতন সেই সাথে অশ্লীল গালি, আর গাড়ির ফ্লোরে পড়ে গেলেন। পানি চাইলে গরম কী জানি দেয়া হল। কিছুটা ভালো লাগলেও মহসীনের সঙ্গে তার আর দেখা হল না। সারাদিন সারারাত পার হল। মনে হল রক্তে তার দুই ঠোঁট এক সঙ্গে লেগে গেছে। জিহবা দিয়ে অনুভব করলেন ঠোঁটে রক্ত। তাকে আন্ডার গ্রাউন্ডে বন্দি করে রাখা হল। তার শরীরের অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। সকালে হঠাৎ দরজা খুলে দুইজন তাকে ঠেলে উঠিয়ে
গার্ডরুমে নিয়ে গিয়ে। সাবান কাপড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পড়লেন। তাকে সেলে বন্দি রাখা হয়। খেতে দিলেও এভাবে দুই-তিনদিন কেটে গেল । সঙ্গী মহসীনের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় তার মনটা অস্থির হয়ে উঠে কিন্তু কোনো উপায় নাই একদিন রাতে তাকে চোখ বেঁধে গাড়িতে করে আন্ডারগ্রাউন্ডের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।
চোখের বাঁধন খুলে তীব্র আলোতে বসিয়ে দেয়া হয় দশটি প্রশ্ন ও কাগজ কলম। প্রশ্নগুলোর মধ্যে ছিল হোয়েন ইউ ফাস্ট ইন্ডিয়ান এজেন্ট? হোয়াট ইউওর লাস্ট ডিসকারশন? হোয়ার ইউয়োর ম্যাট?। শামসুল হক এই সব প্রশ্নের উত্তর না
লেখায় একজন গালাগালি করতে থাকে। আবার চোখ বেঁধে একটি ঘরে ঢুকিয়ে তার উপর শুরু হল অত্যাচার। হ্যান্ডকাপ দিয়ে টেবিলের সঙ্গে তার বুক চেপে দিলে তার মনে হল তার সারা শরীরে আগুন। কাগজ কলম রাখা ঘরে আবার তাকে
এনে অত্যাচার চলতে থাকে। কয়েকজন কী যেন বলাবলি করে তাকে সেলে আনার পর নয়দিন একইভাবে চলতে থাকে অত্যাচার। ডিউউনের ওপর তাকে মারতে থাকে। শাসমুল হক দৌড়াচ্ছেন দেয়ালে বাধা পাচ্ছেন, উটের পায়ের সঙ্গে তাকে বেঁধে তারা বলে, ্#৩৯;তোমকো এইসা মারেগ্#া৩৯;। শামসুল হকের মাথায় নানা চিন্তা। একদিন সকালে তাকে জানানো হয় কোর্টে যেতে হবে। বেস কমান্ডার আয়েসউদ্দিন সিএনসি আসগর খানের ভগ্নিপতি। সেদিন আয়েস উদ্দিন ছুটিতে ছিলেন। কোর্টে সামসুল হকের সঙ্গে মহসীনের দেখা হয় দুজনে দুজনের দিকে তাকান কিন্তু কোনো কথা হল না। কোর্ট মার্শালে তাদের দুজনের বারো বছরের সাজা দেয়া হয়। শামসুল হক নানা কথা ভেবে সময় পার করলেন। বেস কমান্ডার আয়েস উদ্দিন ছুটি শেষে এসে তাদের বারো বছরের সাজা দুই বছর করে তাদের ঢ্য পাঠিয়ে দিলেন হায়দ্রাবাদে। তাদের রাখা হলো খারাপ জায়গায়। মুনু নামে এক সিন্ধি খাবার পানি দিলো, শোবার ব্যবস্থা করে দিলো। পরের দিন সকালে এক হাবিলদার
তাকে ও তার সহকর্মী মহসীনকে ঝাড়ু দিয়ে ঘর ঝাড়ু দিতে বললো। বিছানায় বসে থাকা কয়েক ব্যক্তি শামসুল হকাল বললেন হোয়াটস ইওর নেম? আর ইউ বেঙ্গলি? পরিচয় দিলেন তিনি সিন্ধু ইউনিভর্সিটির ভিসি আললানা। তার সঙ্গে থাকা সঙ্গীরা হলেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জিএম সাইদ ও সিন্ধুর কয়েকজন ব্যক্তি। তারা শামসুল হককে জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা সেই যারা বেদিন বেস থেকে সীমান্ত পার হবার চেষ্টা করেছিলে জং সংবাদপত্রে ছাপা ছবির সঙ্গে তাদের চেহারা মিলালেন। বললেন বাঙালিদের অধিকারের কথা বলার কারণে তাদের বন্দি করে আনা হয়েছে। তার। শামসুল হক ও মহসীনের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার না করার জন্য হাবিলদারকে বলে দিলেন। শামসুল হককে তাদের সঙ্গে আনতে বললেন কিন্তু
শাসুসুল হক বললেন তিনি মহসীনের সঙ্গে থাকবেন। ঝাড়ুদারের কাজ না দিয়ে তাদের দেয়া হলো কার্পেট তৈরির কাজ। কয়েকদিন পর মুক্তির জন্য তাদের আবেদন করতে বলা হলো কিন্তু শামসুল হক ও মহসীন রাজি হলেন না। দুইমাস আঠারো
দিন বন্দি থাকার পর ১৪ আগস্ট তারা মুক্তি পেলেন। সিন্ধু ইউনিভার্সিটির ভিসি আললানা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জিএস সাইদ হাসপাতালে শামসুল হকের সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন সিন্ধিদের স্বাধীনতার জন্য বাঙালিরা কিভাবে সহযোগিতা দিতে পারবে? শামসুল হক উত্তরে বললেন অন বিহ্যাভ অফ বাংলাদেশি ন্যাশন রক্ত দিবেন, জীবন দিবেন। একথা শুনে তারা তাকে চুমু দিলেন। টাকা দিতে চাইলেন। শামসুল হক টাকা নিলেন না। তারা শামসুল হককে বললেন বাইরে অপেক্ষা করছে লাল গাড়ি, তাদের নিয়ে যাবে সিন্ধু ইউনিভার্সিটি। সিন্ধু ইউনিভারসিটিতে তাদের সঙ্গে দেখা হলো বহু বাঙালি ছাত্রদের সঙ্গে। দুইদিন পর তারা মোহাম্মদ খান নামে একজনের বাড়িতে দাওযাতে গেলেন, খেলেন সিন্ধিদের
প্রিয় খাবার ইলিশ পোলাও, উপহার পেলেন সিদ্ধি টুপি। সেখান থেকে ফিরলেন বেদিন এয়ার বেসে। গার্ডরুমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অবাঙালি সার্জেন্ট অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করলো। বুকে লাথি মেরে আধ মরা করে দিলো। সন্ধ্যায়
তাদের নেয়া হলো থানায়। থানার দারগাটি ছিলেন সিদ্ধি। তিনি তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে ৫০ ধারা দেখিয়ে, তার বাড়িতে রেখে খাইয়ে, সকালে ছেড়ে দিলেন। শামসুল হক মহসীনকে দিয়ে মনোয়া রেল স্টেশনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন কিন্তু তাদের কাছে টাকা নেই । হঠাৎ করে বাগানের মালিক শামসুল হকের হাতে চার হাজার টাকা আর ঘড়ি দিলে। শামসুল হক মহসীনকে সঙ্গে নিয়ে দেরি না করে করাচির দিকে রওনা দিলেন। এখানে ফেডারেল এরিয়ার একটি বাড়িতে থেকে বিমানের টিকিটের চেষ্টা করলেন। ২০ আগস্টের পর বিমানের দুটো টিকিট পেয়ে । করাচি থেকে ঢাকায় বদলি হওয়া একটি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শামসুল হক সাজলেন পরিবারটির চাকর, মহসিন স্যুট পরে বদলি হওয়া ভদ্রলোকটির ভাই সাজলেন। বিমানে উঠে তারা দুজনে খুবই সতর্ক থেকে, ঢাকায় যখন পৌছালেন তখন প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো।
চারিদিকে থমথমে আর ভয়াবহ পরিস্থিতি। শামসুল হক মহসীনকে তার সঙ্গ ছেড়ে নিজের জায়গায় চলে যেতে বলে ট্যাক্সিতে গেলেন আর.কে মিশন এলাকায় বোন হেলানাদের বাড়িতে গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা জানালা ভাঙা কেউ নেই। প্রতিবেশী লাইলীর মা-এর কাছে জানলেন বোন হেলানা পূর্ব রামপুরায়। তাদের সঙ্গে দেখা করলে তারা তাকে আটকে দিলেন। শামসুল হক তাদের বলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিবেন। তারা এ কথা শুনে তাকে বাধা দিলেন না। অবশ হয়ে যাওয়ার মতো হাত-পা নিয়ে কোনো রকমে বাসে উঠে আরিচাঘাটে এসে দেখেন পাকিস্তানি সৈন্যরা বাস থেকে তরুণ যুবকদের ধরে নিয়ে গেল। ভাগ্যক্রমে তিনি রক্ষা পেয়ে ঈশ্বরদী হয়ে আব্দুলপুর পৌঁছে দেখেন আব্দুলপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের চারিধারে থৈ থৈ পানি। অবাঙালি ফেরিওয়ালা রফিক, শফিক একটি দোকানে বসে পিস্তল নাড়াচাড়া করছে। শুনতে পেলেন তার শ্বশুর মোশারফ হোসেন পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সমর্থক হয়েছেন। প্রচণ্ড ক্ষোভে তার, ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। সন্ধ্যায় ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি পৌঁছালে মা-বাবা, স্ত্রীর কাছে ঘটনাটি শুনে ক্ষোভ বেড়ে গেল। স্ত্রী তোহারার অনুরোধে নিরাপদ স্থানে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজেদার রহমান তাকে বলেন ্#৩৯;স্যার আপনাকে নিতে এসেছি, আমাদের সঙ্গে চলুন্#৩৯;। শামসুল হক তাদের জানালেন তিনি সীমান্ত পার হতে চান। তারা তাকে নিয়ে গেলেন জুম্মার নামে একব্যক্তির বাড়ি। তারা তাকে এলএমজি দিতে চাইলে তিনি চাইলেন এসএমজি। তিনি ইসমাইল, ইকবাল, আব্দুল আকতার এ রকম কয়েকজনের সঙ্গে থেকে গেলেন। ইকবাল তাকে বলেন তার শ্বশুর পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর সমর্থক হয়েছেন তাকে শাস্তি দিতে হবে।
শামসুল হক তাকে বলেন এ মুহূর্তে নয় তিনি সীমান্ত পার হয়ে গেলে এ কাজটি করতে। করিমপুর গেট দিয়ে শামসুল হক চিতলাদিয়ার দিকে চলে গেলেন। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিম বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার পানিপিয়া ক্যাম্পে দেখা পেলেন ৭নং সেক্টরের সাব সেক্টর ৪-এর সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ও কাজীপাড়া সাব সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর রশিদের। তারা শামসুল হককে বলেন এয়ার ফোর্স রাইজ করেনি, তাই তাকে তাদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এয়ার ফোর্স রাইজ করলে তাকে এর সঙ্গে যুক্ত করে দেয়া হবে। তাকে দেয়া হল ট্রেনিং নেয়া সাতটি গ্রুপ।
সীমান্ত পার হয়ে এসে শামসুল হক শুরু করলেন অ্যকশান অপারেশন। পীরগাছার চিতলিয়ায় পজিশন নিলেন। অ্যাকশন করলেন পাকিস্তানি সৈন্যদের সমর্থক আসাদ চেয়ারম্যানের বাড়িতে। রামাগাড়ীতে অ্যাকশনের সময় শহিদ হন তার সঙ্গী ইসমাইল ও আব্দুল। ১৫ ডিসেম্বর শামুসল হক গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে অ্যাকশন করে ১৬ ডিসেম্বর গান স্যালুটের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলার পর, দেখেন ঈশ্বরদীর দিকে যাওয়া একটি রেলইঞ্জিন থেকে এক অফিসার বাইনোকুলার দিয়ে চারিদিকে দেখছে তখনো ঈশ্বরদী মুক্ত হয় নি। লক্ষ করলেন সুগার মিলের ভক্সওয়াগন গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা। মাজারের কাছে, মিলের স্কুলের পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের ডিফেন্স নিতে বলে, গাড়িটির চালক আব্দুল রাজ্জাককে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে বাজারের দিকে যেতেই এক ধোপা তাদের সেখান থেকে সরে যেতে বলে। এসময় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া একটি রকেট এসে পড়লে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন।্#৩৯; বৃষ্টির মতো গুলি আসতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর গোপালপুর সুগার মিলের নিয়ন্ত্রণ নেবার পর নারী, শিশু বয়স্কদের বাদ দিয়ে অপরাধীদের শান্তি দেবার কারনেই অবাঙালীরা গুলি ছুড়তে থাকে চালাই হত্যাযোগ্য সঙ্গীদের পজিশনে রেখে ঈশ্বরদীর দিকে কেবিনের কাছে ট্যাংক লাগিয়ে ফিস প্লেট তুলে মিলের গাড়িতে আব্দুলপুর এসে রাজশাহী সান্তাহার রেললাইন তুলে ফেলে নর্থ সুগার মিলে ফিরেন। মাঝ
রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করলে রেল গাড়ির ইঞ্জিন পড়ে গেল। সুগার মিলের নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালি করা হয়। ১৩ দিন পর ঢাকা থেকে আসা মিলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে ১৯৭২ সালে ৫ জানুয়ারী ঢাকা এয়ার বেসে যোগ দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। কিছু বিষয় তাকে ঘাবরিয়ে তুললে প্রচন্ড কষ্ট পেলেন। বিষয়টি উচ্চ মহলে জানানোর চেষ্টা করেন বলেন দেশ গড়তে অবদান রাখতে চান। যোগ্যতা ভিত্তিতে প্রমোশন চান। পরিস্থিতি ঘোলাতে হয়ে উঠলে গ্রেফতার হন। কারামুক্তির পর আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেন। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলতে পাড়া আব্দুলপুর গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক এখনো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেন । বিশাল হৃদয়ের এই ব্যক্তিত্বের একটি খাবারের দোকান আছে আব্দুলপুর রেল স্টেশনে। স্মৃতিচারণে বলেন অনেক কিছুই সরকার প্রধানকে জানানো হতো না বরং ভুল বোঝানো হতো ফলে ঘটতে থাকে অপ্রত্যাশিত অনেক ঘটনা। শুধু আব্দুলপুর নয় বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি অনেকের রাজনৈতিক গুরু।
লেখক
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহক, রাজশাহী