রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫
Logo
Adventures of Shaukat Ara

বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরার দুঃসাহসিক অভিযান

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশের সময়: ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪, ০২:৩৬পিএম

বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরার দুঃসাহসিক অভিযান
বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরার দুঃসাহসিক অভিযান

রাজশাহী জেলা সদরের পশ্চিমে রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ সড়কের পাশে হরিপুর গ্রাম। এই গ্রামের শওকত আরা তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। অসহযোগ আন্দোলন থেকে রাজশাহীতে শুরু হল প্রতিরোধের প্রস্তুতি। রাজশাহী পুলিশ লাইন, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ক্যাম্প, আনসার ক্যাম্পের স্বাধীনতাকামী বাঙালীরা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করলো রাজশাহী পুলিশ লাইনের স্বাধীনতাকামী বাঙালি পুলিশেরা।

পাশের গ্রাম-কাঁঠালবাড়িয়া গ্রামের একটি নিম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে শওকত আরা দেখলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রীবাহী বাস থামিয়ে নারী পুরুষদের আলাদা করে লাইনে দাঁড় করাচ্ছে। জোর করে তাদের গাড়িতে তুলে নিচ্ছে নারীদের। পুরুষদের দরি দিয়ে বেঁধে গাড়িতে তুলে নির্যাতন করছে। পাকিস্তানি সৈন্য ও মিলিশিয়ারা গ্রামের দিকে আসছে দেখে দৌড়ে ফিরে এলেন গ্রামের বাড়িতে।

ভাই জিল্লার রহমান, মামাতো ভাই সাইদুর রহমান, কালু, যে যা পেল তাই দিয়ে গলির বাঁকে অবস্থান নিলেন। অস্থির শওকত আরার ফুফু বানু শওকত আরা তার ভাই শাখাওয়াত, আব্দুস সালাম ও অন্যান্যদের একটি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দরজায় বসে থাকলেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা শওকত আরার চাচা ভাসানী ন্যাপ সামর্থক গোলাম রাব্বানী, লেনিন, আমানুল্লাহ, ড. শহিদুল্লাহ, আজিজ, হেলেন কে ধরে লাইনে দাঁড় করিয়ে আমিনকে জোর করে সাথে নিয়ে স্বাধীনতাকামীদের খুঁজতে থাকে। তার ফুফু বানুকে ঘরটি দেখিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা জিজ্ঞাসা করে “আন্দার কোন?” উনি সাহস দিয়ে উত্তর দেন জেনানা‌।

পাকিস্তানি সৈন্যরা লাইনে দাঁড় করানোদের ওপর নির্যাতন করতে থাকে। বিকেলে পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান থেকে গ্রামটির ওপর গুলি করা হলে শওকত আরা পরনের এক কাপড়ে বোনের ছেলে সাইদুর রহমান কালুর শিশু সন্তান মাসুদকে কোলে নিয়ে গন্তব্যহীন অবস্থানে দৌড়াতে থাকেন। রাস্তায় পেলেন মিনা ও তার মেয়ে বাণীকে। গ্রামের দিকে যাবার সময় শুনতে পেলেন প্রসব ব্যথায় এক নারীর চিৎকার। তাকে সাহায্য করে কখনো হেঁটে কখনো দৌড়ে দারুসা গ্রামে পৌঁছালেন। কয়েকদিন পর খবর পেলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে, শুনতে পেলেন গুলির শব্দ।

দেশের জন্য কিছু করতে হবে এই ভাবনা তাকে উদগ্রীব করে তুললে রাজশাহী জেলা সদরে ফিরলেন।মুক্তিবাহিনী অ্যাকশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সুযোগ বুঝে নিলেন সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং। বান্ধবী কামরুন্নাহার বিনার ভাই রাজশাহী জেলা সদরের শেখ পাড়ার ছেলে রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এর শিক্ষার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মনায়েম মঞ্জুর (তানোর থানার অপারেশন শহিদ) তাকে অস্ত্র আনা নেয়ার প্রস্তাব দিলে প্রস্তাবটি গ্রহণ করে শওকত আরা কাজ শুরু করেন। শিখে নিলেন গ্রেনেড ছুড়ার কৌশল। বান্ধবী বিনার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম মোনায়েম মঞ্জুর, ফুফাতো বোন হাসমত আরা হাসিকে সঙ্গে নিয়ে রাজশাহী থেকে ট্রেনে চব্বিশ নগরে গিয়ে গণি নামে এক গ্রামবাসী সহযোগিতায় তার বাড়ি থেকে গ্রেনেড সংগ্রহ করে কৌশলে তা পরের দিন রাজশাহী জেলা সদরে এনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোনায়েম মনজুরের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন।

চব্বিশ নগর, কাকন-হাট থেকে গ্রেনেড, অস্ত্র নিয়ে রাজশাহী জেলা সদরে আনা-নেওয়া করতে থাকলেন। হারুপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালামের কাছে শিখলেন রাইফেল চালানো । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অপারেশনের জন্য গ্রামের ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুরের রিক্সায় মুক্তাঅঞ্চল থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান গামা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী-মনসুরের আনা গ্রেনেড এবং অস্ত্রের ট্যাংকটি পৌঁছে দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্মরত রাজশাহী বেতারের বিশিষ্ট শিল্পী দেওয়ান আব্দুল খালেকের তালাইমারীর বাড়িতে। ৭ নং সেক্টর সাব সেক্টর-৪ এর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নির্দেশ দেন রাজশাহী জেলা সদরের ঘোড়ামারা পাড়ায় কুঞ্জমৈত্রীর বাড়িতে করা রাজাকার ক্যাম্প বোয়ালিয়া থানার পাশে মোসলেম আলীর বাড়িতে করা আলবদর ক্যাম্প, বিদ্যুৎ অফিস সহ কয়েকটি স্থানে অপারেশনের।

এই কাজে সহযোগিতা করার জন্য তখনকার বুয়েটের ছাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবর আলী কথ বললেন শওকত আরার সাথে। সবকিছু ঠিকঠাক করে বাবর আলী পরামর্শ করেন রাজশাহী সিটি কলেজর শিক্ষক আব্দুল মোমিনের সাথে। পরামর্শ মত রাজশাহী পাবলিক লাইব্রারি সেক্রেটারি, সিটি কলেজের আরেক শিক্ষক এহিয়া, লাইব্রেরীয়ান রেজাউল আহমেদ ও পিয়ন মজিবুর রহমানের সাথে কথা বলেন। ৭ অক্টোবর শওকত আরা বাবর আলীকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রিক্সা চালকের সহযোগিতায় ৪০ ইঞ্চি একটি ট্রাঙ্কে চারটি এ্যান্টি ট্যাংক মাইন, এক্সপ্লোসিভ, এস এম জি, গ্রেনেড, কারবাইন ম্যাগজিন নিয়ে রাজশাহী কোটের পশ্চিম দিকে থেকে এ্যাডভান্স হলে, রাজশাহী কোর্টের কাছে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের জিজ্ঞাসা করে “তোম কোন? কাহা যাহারাহা?” বাবর আলী তাদের বললেন, “মেরা বাহিন ইউনিভার্সিটির হলে রাখতে যাচ্ছি।

এভাবে তারা হরগ্রাম নুরু মিলের পেছন দিয়ে লক্ষ্মীপুরে পাকিস্তানি সৈন্যদের চেকপোস্ট পার হবার সময় মোটরসাইকেলে টহল দেয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দার নজরে পড়ে গেলে কৌশলে তারা এ্যাডভান্স হতে থাকেন। বরেন্দ্র যাদুঘরের কাছে আবার তারা নজরে পড়লেন ওই গোয়েন্দাটির। শওকত আরার পরনে সাদা সারওয়ার, সাদা কামিজ মাথায় সাদা ওড়না। রোমাঞ্চকর পরিবেশে তারা ট্রাঙ্কটি পৌঁছে দিলেন

পাবলিক লাইব্রেরীতে অপেক্ষা করা লাইব্রেরীয়ান রেজাউল আহমেদ পিয়ন মজিবুরের কাছে‌। বিকেলে অপারেশন কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাৎ হোসেন রোওশন পি এন গার্লস স্কুলের কাছে ঐ গোয়েন্দার নজরে পরে গেলে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করে পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে দেখেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমর্থকদের ট্রেনিং চলছে। কৌশলে লাইব্রেরীর ভিতরে ঢুকে বই পরতে থাকেন। বুঝে ফেলেন অপারেশনের কথা প্রকাশ হয়ে গেছে। অপারেশন পোসপন্ড করে কৌশলে চলে গেলেন সেল্টারে চলে গেলে পরের দিন শওকত আরা একাই আবার ঝুঁকি নিয়ে সেই অস্ত্র ভর্তি ট্র্যাঙ্কটি পাবলিক লাইব্রেরী থেকে নিয়ে মহিষবাথান এলাকার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দেন । তারা কথা জেনে ফেলে পাকিস্তানি সৈন্যরা। তাকে ধরার জন্য লোক লাগায়।

পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলা সার্চ লাইট এর মধ্যেই ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা নদী দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আশ্রয় নেন ভাতের মুর্শিদাবাদ জেলার শেখপাড়ায় তাদের জমির আদিধারের বাড়িতে। কোলকাতা নারী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করার সময় দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। ১৮ ডিসেম্বর রাজশাহী শত্রু মুক্ত হলে মুক্ত স্বদেশে ফেরার অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহীতে ফিরেন। তার অবদানকে এড়িয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও পাননি স্বীকৃতি। অবশেষে স্বীকৃতি পান। এক সময় যুক্ত হন শিক্ষকতার সাথে অবস্থান নেন পাবনা অঞ্চলে। আমার সাথে ও আলোক চিত্রি টমির সাথে আলোচনার পর সাংবাদিক আব্দুল হাই জার্মানির রেডিও ডলেট ভেলেতে তার সাক্ষাৎকার প্রচার করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শওকত আরা চলে গেছেন না ফেরার দেশে।

(লেখক- তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী)