রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫
Logo
Love that mother, on memory page for Sona Manid 14 February

ভালবাসা সেই মাকে, সোনা মনিদের জন্য স্মৃতির পাতায় ১৪ ফেব্রুয়ারী

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রাহমান বাবু

প্রকাশের সময়: ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৮:৫৮পিএম

ভালবাসা সেই মাকে, সোনা মনিদের জন্য স্মৃতির পাতায় ১৪ ফেব্রুয়ারী
ভালবাসা সেই মাকে, সোনা মনিদের জন্য স্মৃতির পাতায় ১৪ ফেব্রুয়ারী

১৪ ফেব্রুয়ারী আমার মত অনেকের কাছে দিনটি অন্য রকম। সে দিনটির কথা কারো মনে আছে কি ? সব কিছু কেমন যেন বদলে যাচ্ছে এক সময় হয়তো আমারো মনে থাকবে না অনেক কিছুই। অনেকেরই মুখ ভেসে উঠে সেদিন ১৪ ফেব্রুয়ারী যারা ছিলেন রাজপথে। ক্ষমতায় তখন জেনারেল এরশাদ। কয়েকটি ছাত্র সংগঠন নিয়ে গঠিত সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্রদল, আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঢাকায় কি হচ্ছে তা জানার জন্য অপেক্ষা করছে সবাই। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ছাত্র নেতাদের চিন্তাও বেড়ে গেল। একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। খবর এলো ঢাকায় ছাত্ররা মিছিল করে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে দিয়েছে। লাঠি চার্জ, গুলি, ধরপাকড় হয়েছে। দিপালী, কাঞ্চন সহ কয়েক জন গুলিতে মারা গেছে। শিশু একাডেমীর শিশুরা নির্যাতিত হয়েছে। জেনারেল এরশাদ সমর্থিত লোকজনও বিব্রত।

রাজশাহীতে বিক্ষোভ হবে ভাঙ্গা হবে ১৪৪ ধারা। ছাত্র সমিতির ফুল, কুটি খবর দিল রাজশাহী কলেজে যেতে হবে। ছাত্র নেতা ও সকলে সেখানে জমায়েত হচ্ছেন। রাস্তায় ছাত্র দলের হীরা (নিউ ডিগ্রী কলেজের ছাত্র সংসদে ছিল) আমাদের সাথে যোগ দিল। রাজশাহী কলেজ শহীদ মিনারে ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সেদিন যারা ভূমিকা রাখেন তারা হলেন নাসির আহমেদ বিদ্যুৎ সারওয়ারি কামাল স্বপন, লিয়াকত আলী লিকু, রাগীব আহসান মুন্না, সালাউদ্দীন বেবী (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ), মজিবুল হক বকু, কাইয়ুম, শিবলী, রায়হান, শফিক, টুনু, সিরাজুল ইসলাম, শ্যামল, লতিফ, হাবিবুর রহমান বাবু, জগলু, সেন্টু, আজম, শরিফুল ইসলাম বাবু, মুকুল, মনি, মাসুদ, শফিক এরকম অনেকেই (মুখ মনে পড়লেও নাম মনে পড়ছেনা)।

ছাত্র সমিতির ফুল, কুটি ও আরো অনেকে চাইলো এক সাথে যৌথ মিছিল। হীরা জানালো ছাত্রদল একটু সময় নিবে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বললেন দেরী করা যাবে না। দেরী হলে কর্মসূচী বাধা পাবে। সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র দলের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। হীরা চাইলো ছাত্রদলের মিছিল সংগঠিত করতে আমি তাকে সহযোগিতা দি। ফুল, কুটি চাইলো আমি তাদের সাথেই থাকি। শ্লোগান উঠলো। শ্লোগানে অংশ নিয়ে হীরা চলে গেল ছাত্রদল নেতা রিজভীর খোঁজে। দৌড়ে দৌড়ে মিছিল। শ্লোগানে উত্তপ্ত সবাই।ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব থাকলেও সবাই ঘামছে।

খবর এলো বিশ্ববিদ্যালয়, বিআইটি, মেডিকেল কলেজ ছাত্র হোস্টেলসহ মেসগুলিতে সবাই উত্তপ্ত। পথচারী আশে পাশের  দোকান, বাড়ী ঘরে সকলের চোখে মুখে আতংক কি জানি কি ঘটে যায়, ভেঙ্গে গেল ১৪৪ ধারা। গণকপাড়া হয়ে আমাদের মিছিলটি নিউমার্কেটের আশপাশ দিয়ে যখন মেডিকেল কলেজের সামনে তখন জানা গেল ছাত্রদলের রিজভী, হীরা, জিল্লু, ডিউক, আবিদ, বাচ্চু, মন্টুদের নেতৃত্বে ছাত্রদল মিছিল করছে। সংখ্যায় কম হলেও ভারা সাহস নিয়ে ভেঙ্গে দিলো ১৪৪ ধারা। সংগ্রাম পরিষদের মিছিল নিউ ডিগ্রী কলেজ হয়ে রাজশাহী জেল খানার সামনে আসতেই হঠাৎ করে পুলিশের গাড়ি আলো বন্ধ করে থেমে গেল, শুরু করে লাঠিচার্জ।

অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার ধারের এক বাড়ীর মা এগিয়ে এসে আমাকে রক্ষা করলেন। ঐ বাড়ীর সকলে ঘিরে রাখলেন আমাকে। দুরে শ্লোগান চিৎকার হচ্ছে। মন আর মানছে না। কারো সাথে যোগাযোগের অবস্থা নেই। গোঙ্গানোর শব্দ পেলাম কিন্তু কিছু দেখা যাচ্ছে না আস্তে আস্তে গোগানোর শব্দ থেমে গেলো। ধুলো কাঁদা মাখা প্যান্ট, সার্ট জুতো নিয়ে বাড়ীটির প্রাচীর টপকে বেরিয়ে পরলাম। ঐ বাড়ীর মা ও অন্যান্যরা সহযোগিতা দিলেন। টিটি কলেজে পেলাম সালাউদ্দিন বেবি, ফুল, কুটিকে। লক্ষীপুর মেডিকেল কলেজ এলাকায় চলছে শ্লোগান চিৎকার খন্ডযুদ্ধ।

ওদিকে যেতে আমরা বাধা পেলাম, বেবিস থেকে গেলো সেখানে। ফুল কুটিকে সাথে নিয়ে আসার সময় ফায়ার ব্রিগেড রাস্তায় দেখা হল লতিফের সাথে চলতে চলতে কথা ও পশ্চিমে আমরা পূর্বে।পুলিশের গাড়ী দ্রুত যাওয়া আসা করছে। গাড়ীতে থাকা পুলিশ এদিক ওদিক লক্ষ করছে। রাজশাহী কলেজের সামনে আসতেই ছোট্ট একটি ছেলে সাইকেলে এসে বলে গেলো জেলখানার কাছে পুলিশ একজনকে ভীষণ ভাবে......... । অবস্থা খারাপ হয়তো.......... একথা বলে ও দ্রুত চলে গেল। হীরা রিজভীদের সাথে যোগাযোগ হলো। জেলখানার সামনে কার ভাগ্যে কি ঘটলো কেউ তা বলতে পারলো না। তার কোন খবর পাওয়া গেল না।

পরেরদিন বিদ্যুৎ অফিসের সামনে এক ছাত্রনেতা বললেন আমি কোন সংগঠন থেকে মিছিলে গেয়েছিলাম তার প্রশ্নে থমকে গেলাম। নেতাটি বললেন যদি কোন কিছু ঘটে যেতো তখন কিভাবে তারা আমাকে ট্রেস করতেন। রেগে গিয়ে বলেছিলাম কোন সংগঠন নয়, প্রতিবাদে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। উত্তরে তিনি খুশি হন নি, জেলখানার সামনে কার কি ঘটেছে তার জানা নেই। বেশ কিছুদিন পর সেই ছাত্র নেতার সাথে দেখা, বললেন এরশাদ সাহেবকে সমর্থন সদিয়ে তার ছাত্র সংগঠন সংগঠিত করতে তিনি সক্রিয়। আস্তে করে বললেন তার সাথে থাকলে আমার ভাল হবে রাজী হতে পারিনি, দেখাও আর হয়নি। হয়তো তিনি বড়সর কিছু হয়ে গেছেন।

রাজশাহী কলেজের সামনে সাইকেল নিয়ে খবর দিতে আসা সেই ছোট্ট ছেলেটিকেও আর পাইনি। জেলখানার সামনে কার ভাগ্যে সেদিন ওই ঘটনাটি ঘটেছে আজও কেউ তা বলতে পারেন না। রাজশাহী জেল থানার পাশে আমার কাছে ঐতিহাসিক সেই বাড়ীর মা সেই সংগ্রামী রাস্তা আমি  ভুলে যায়নি। সেই রাস্তার, বাড়ীটির পরিবর্তন হয়েছে। নেই সেই মা ওই বাড়ীর ছোটরা এখন বড় হয়েছে।

১৪ ফেব্রুয়ারী স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সেই বাড়ীর সামনে আমাকে যেতেই হয়। সেই রাস্তাগুলি সেই বাড়ী আমাকে হাতছানি দেয়। ভালবাসা দিবসে আমার হৃদয় নিংড়ানো ছোট্ট ভালবাসা নির্যাতিত ছোট্ট মনিদের, দিপালী, কাঞ্চনদের জন্য, ছোট্ট ছেলেটির জন্য সেদিন যে খবর দিতে এসেছিলো। ভালবাসা সেই মাকে সেই বাড়ীর সকলকে। ভালবাসা তার জন্য যার খবর আজো কেউ বলতে পারেনা। ভালবাসা তাদের সেদিন যারা ছিল রাজপথে। আমাকে রক্ষাকরা সেই বাড়ীর সকলে এই দিনটিতে অপেক্ষা করে আমার জন্য। তারা স্বরণ করে সেইদিনের স্মৃতিকে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে এ আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে ভূমিকা রাখেন শিল্পী লেখক সাংস্কৃতিক কর্মীরা। এক পর্যায়ে রাজনৈতিক সংগঠন আন্দোলেন শুরু করলে তা গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করেন, দায়িত্ব নেন তত্তাবধায়ক সরকার।

লেখক  : ওয়ালিউর রহমান বাবু,সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজশাহী