রবিবার, মার্চ ১৬, ২০২৫
Logo
Teacher-Student Day
শিক্ষক-ছাত্র দিবস

শিক্ষক---- ছাত্রের মিলিত রক্তের ধারার ১৮ ফেব্রুয়ারী

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশের সময়: ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৮:৩০পিএম

শিক্ষক---- ছাত্রের মিলিত রক্তের ধারার ১৮ ফেব্রুয়ারী
শহিদ নুরুল ইসলাম , শহিদ ড. শামসুজ্জোহা , শহিদ আব্দুস সাত্তার।

আহত ছাত্রদের সেবা করতে পেরে আমি ধন্য। ছাত্রের দু’ ফোঁটা রক্তের স্পর্শে আমি পবিত্র। এরপর শুধু ছাত্ররা নয় আমরা সবাই মিলে দানবীর শক্তিকে রুখে দাঁড়াবো। মরতে যদি হয় আমরা সবাই মরবো। এটি উনসত্তরের স্বৈরাচার বিরোধী গণ-অদ্ভ্যুত্থানের একটি প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। এই কন্ঠস্বর কোন সংগ্রামী ছাত্র, শ্রমিক-জনতা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির নয়। এটি ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রিয় শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহার শপথের কথা। বুকের গভীর থেকে উচ্চারিত তার এই শপথের বাণীই সেদিন ছাত্র জনতার মর্মবাণীতে পরিণত হয়। কেঁপে উঠে গণ-বিরোধী, স্বৈরাচারী আইয়ূব খানের  শাসন, পতন হয় তার। এই দিন পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্মম বেয়নেট চার্জে শহিদ হন তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা। তৎকালীন ইপিআরের গুলিতে শহিদ হন ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম। গুলিবিদ্ধ ও চরম নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়ে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মারা যায় স্কুল ছাত্র আব্দুস সাত্তার। 

উনসত্তরের ১৭ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হকের হত্যা ও গণ নির্যাতনের প্রতিবাদে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডাকা হয় সাধারণ ধর্মঘট। সেদিন রাজশাহী শহরে ছাত্র মিছিলের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপে আহত হন ১৬ জন ছাত্র। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘটনাস্থলে আসেন ড. শামসুজ্জোহা। তিনি আহত ছাত্রদের বুকে টেনে নিয়ে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। নিজের গাড়িতে আহত ছাত্রদের নিয়ে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আহত ছাত্রদের আশ্বাস দিয়ে বলেন, “ভয় নেই, আমরা আছি তোমাদের পাশে।” রাত দশটায় বিশ্ববিদ্যালয় শহিদ মিনারে শিক্ষক-ছাত্রদের প্রতিবাদ সভায় উচ্চারিত করেন তার শপথের কথা। 

পরেরদিন ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে নামানো হয় ইপিআর ও সেনাবাহিনী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার প্রস্তুতি নেয় ছাত্র জনতা। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মধ্য শহরের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে করে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে মধ্য শহরের দিকে আসার প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে অস্ত্র তাক করে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের সামনে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা নির্দেশ দেয় “কিল্ড দেম, ফায়ার”। ডক্টর শামশুজ্জোহা ছাত্রদের বাঁচাতে দৌড়ে গিয়ে, চীৎকার করে বললেন-“প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা এখনই ভেতরে চলে যাবে।” এরপরও সেনাবাহিনীর ঐ কর্মকর্তাটি আবারো নির্দেশ দেয়, ‘ফায়ার’। শুরু হয় বেপরোয়া গুলীবর্ষণ। আহত হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাজী আবদুল মান্নান, ড. কছিমউদ্দীন মোল্লাসহ অনেককে। নির্মমভাবে বেয়েনেট চার্জ করা হয় ড. শামশুজ্জোহাকে। এই ঘটনায় ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনার খবর আসার সাথেসাথে মধ্য শহর হয়ে উঠে তুমুল উত্তেজিত। একটি মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ১১ দফা আন্দোলনের নেতা রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র ছাত্রইউনিয়ন নেতা নুরুল ইসলাম। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (তৎকালীন পৌরসভা ভবন) এর ছাদ থেকে ইপিআর নূরুল ইসলামকে লক্ষ্য করে গুলি করলে সোনাদিঘী মসজিদের সামনে তিনি শহিদ হন । তাকে রাস্তায় ছেঁচড়িয়ে পা ধরে টেনে ইপিআররা পৌরসভা ভবনে নিয়ে গিয়ে গাড়ির তলায় ফেলে রাখে। আরেকটি মিছিলে বন্ধু মোসলেম সহ অন্যদের সাথে ছিল রাজশাহী হাই মাদ্রাসা স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুস ছাত্তার। তাকে সেদিন বাড়িতে আটকিয়ে রাখা যায়নি। মিছিলে আসা বড় ভাই আব্দুল আজিজ (বীর মুক্তিযোদ্ধা) কে খুঁজতে এসে সেও যোগ দেয় মিছিলে। সে গুলি বিদ্ধ হয় রাজশাহী কলেজ মহিলা হোস্টেলের পূর্ব পাশে তেঁতুল তলায়। তাকেও রাস্তায় ছেঁচড়িয়ে, পা ধরে টেনে ইপিআররা পৌরসভা ভবনে এনে লাঠি, পায়ের বুট জুতো দিয়ে নির্যাতন করতে থাকলে, এক গাড়ী চালক তাকে কৌশলে তাদের কাছ থেকে তাকে সরিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। ড. শামসুজ্জোহাকে মারাত্মক আহত অবস্থায় সেনাবাহিনী পৌরসভা ভবনে এনে ফেলে রাখে। আহত শিক্ষকদেরও এখানে এনে আটকে রাখা হয়। তাদের চাপে প্রফসর ড. শামসুজ্জোহাকে হাসপাতালে পাঠানো হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে এই সাহসী শিক্ষক বলেন, “সময়মত চিকিৎসা হলে আমি বেঁচে যেতাম”। লাশ নিতে শহিদ নূরুল ইসলামের বাবার উপর শর্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। কেঁপে ওঠে সারাদেশ। পদত্যাগ করেন পাকিস্তানের লৌহ মানব ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খাঁন। প্রত্যাহার হয় আগরতলা মামলা।

শহিদ নূরুল ইসলাম ছিলেন সাহসী ছাত্র নেতা। ঢাকায় ছাত্রইউনিয়নের সম্মেলনে গিয়েছিলেন। ঢাকা তখন ১১ দফা আন্দোলনে উত্তাল। একটি মিছিলের ওপর গুলি চালালে নবরূপ স্কুলের ছাত্র মতিউর শহিদ হয়। মতিউরের রক্তে লাল হয়ে যায় নূরুল ইসলামের পোশাক। মতিউরের লাশ নিয়ে শ্লোগান তুলে সেদিন নূরুল ইসলাম কাঁপিয়ে দেন রাজধানী ঢাকা। রাজশাহীতে ফিরে ১১ দফা আন্দোলনকে তীব্র করতে থাকেন। ১৮ ফেব্রুয়ারী ইপিআরের গুলিতে শহিদ হন তিনি। ছয় মাস চিকিৎসায় থাকা অবস্থায় শরীরে পচন নিয়ে হাসপাতালে মারা যায় স্কুল ছাত্র আব্দুস সাত্তার।

এখানেই শেষ নয়। শহিদ নূরুল ইসলামের পিতা এই অপরাধে রেলওয়েতে কর্মরত তার পিতা আব্দুল কুদ্দুস কে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মূহুর্তে হত্যা করে কিছু অবাঙালি। সূত্রে জানা যায় কিছু বাঙালি তাকে অবাঙালিদের কাছে ধরিয়ে দিলে তিনি আর ফিরে আসেনি। পরিবারে দেখা দেয় সংকট। সবকিছু মেনে নিয়ে পরিবারের সকলে অপেক্ষা করতে থাকেন স্বাধীনতার। মুক্তিযুদ্ধের পর যারা এই দুই পরিবারটির খোঁজ-খবর রাখতেন, দূর্ভাগ্য সেটি আর হয় নি। যাদের উচিত ছিল পরিবারটির খোঁজ-খবর রাখার তারা তা করেননি। আর্থিক অনটনে, রোগে-শোকে মারা যান তার মা। আত্মহত্যা করেন তার দুই ভাই। শহিদ নুরুল ইসলাম-শহিদ সাত্তারদের কথা কেউ মনে রাখেনি এটি বলেছেন দুই পরিবারের সদস্যরা। কষ্টের কথা শহিদ নুরুল ইসলাম-শহিদ সত্তারদের অবদানের স্বীকৃতি নেই ইতিহাসের পাতায়। সবাই ভুলে যাচ্ছে তাদের। অথচ তারা সেদিন গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। এই পরিবার দুইটি তাদের স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন শহিদ নুরুল ইসলাম ও শহিদ সাত্তারকে। তৎকালীন রাজশাহী পৌরসভা শহীদ আব্দুস সাত্তার স্মরণে রাজশাহী শহরের পাঠানপাড়া এলাকায় একটি রাস্তার নাম করণ করলেও এখন তার অস্তিত্ব নেই। আজকের প্রজন্মদের জানতে দেয়া হয়না শহিদ ড. শামশুজ্জোহা, শহিদ নূরুল ইসলাম, শহিদ আব্দুস সাত্তারদের। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে শহিদ ড. শামসুজ্জোহা হল। ১৮ ফেব্রুয়ারী সেখানে পালিত হয় নানা কর্মসূচী। ২০২৪ সালে রাজশাহী সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ শহিদ নূরুল ইসলাম স্মরণে কলেজ টির নাম করণের উদ্যোগ নিবেন বলে জানিয়ে ছিলেন পরবর্তিতে এ উদ্দ্যেগের কথা জানা যায় নি। রাজশাহী হাই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ (বর্তমান হাজি মুহাম্মদ মহসিন সরকারি হাইস্কুল) শহিদ আব্দুস সাত্তার স্মরণে ছাত্রাবাসের নামকরণ করেছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারী কে শিক্ষক-ছাত্র দিবস ঘোষনার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা হয় নি। শহিদ ড. শামসুজ্জোহা, শহিদ নুরুল ইসলাম- শহিদ আব্দুস সাত্তারকে স্মরণীয় হয়ে থাকুক সকল দেশবাসীর হৃদয়ে। শহিদ ড. শামসুজ্জোহা নুরুল ইসলাম- শহিদ আব্দুস সাত্তারকে স্মরনীয় করে রাখতে রাজশাহীতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।ভাষা সৈনিক আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ দিনটি পালন করে। “৬৯” রক্তের সিড়ি দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতার সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর গণ আন্দোলনের মাইলফলক।

লেখক- তথ্য সংগ্রাহক,সমাজ, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজশাহী