১৯৭১ এর ১মার্চ। রাজশাহী কলেজ থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময় কলেজের সামনে রাস্তার ধারে ড্রেনের উপর হিরুর দোকানে চা খাচ্ছিলেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র নেতা খুরশিদ বিন আলম ও রুহুল আমিন মঞ্জু। তখন দুপুর ১টা, তারা বেতারে শুনলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ভাষণে পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিতের কথা।
মুহূর্তেই তারা বুঝে নিলেন কী হতে যাচ্ছে। দেরি না করে কলেজ গেট বন্ধ করে অফিস ভবনের সামনে ছাত্র-ছাত্রীদের জানান রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ছাত্রনেতা মঞ্জুর প্রস্তাবে সাধারণ এক ছাত্রের সমর্থনে ছাত্রনেতা খুরশিদ বিন আলম এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। তখনো কেউ জানতে পারেনি কী ঘটেছে। সভা হচ্ছে দেখে সেখানে আসতে থাকেন ছাত্র নেতা ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা। কে কোন দলের সে পরিচয় ভুলে গড়ে উঠে বৃহত্তর ঐক্য। ঘোষণা করা হয় 'আর কোন দফা নেই, এখন এক দফা স্বাধীনতা'। ছাত্রনেতা খুরশিদ বিন আলম স্পষ্ট বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের আর থাকা হল না, গভীর ষড়যন্ত্র হয়ে গেছে। কলেজের পাশ থেকে সংগ্রহ করা ছোট একটি পাকিস্তানি পতাকায় আগুন লাগিয়ে রাজশাহী কলেজের পতাকাটিও নামিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি এক কর্নেল কলেজ অধ্যক্ষের কাছে টেলিফোনে কৈফিয়ত চাইলে অধ্যক্ষ প্রফেসর শামসুদ্দিন ছাত্রনেতা চৌধুরি খুরশিদ বিন আলমকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলেন। চৌধুরি খুরশিদ বিন আলম তাকে বিষয়টি জানিয়ে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে নিচে নেমে আসেন। ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে কলেজ থেকে মিছিল বের হয়ে কোর্টের দিকে যাওয়ার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য অফিস থেকে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দিতে থাকে ছাত্র জনতা। এসপি অফিস, ডিসি অফিসের পতাকাও নামিয়ে ফেলা হয়। জজ কোর্টের পতাকা নামানো ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ কাজটি করেন রাজশাহী কলেজের সাহসী ছাত্র নেতা দরগাপাড়ার সাব্বির আহমেদ মতি ( বীর মুক্তিযোদ্ধা)। জজ কোর্টের পতাকায় আগুন লাগিয়ে পোড়া কিছু অংশ লাঠিতে লাগিয়ে ছাত্র-জনতার মিছিল বেতার কেন্দ্রের কাছে আসতেই পতাকা ধরে থাকা ছাত্রনেতা চৌধুরি খুরশিদ বিন আলমের দিকে অস্ত্র তাক করে পাকিস্তানি এক সৈন্য। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিছিলটি থমকে যায়। এ অবস্থায় অনেকেই আশ্রয় নেন প্রাচীরের ধারে। সাহসী চৌধুরি খুরশিদ বিন আলম পোড়ানো পতাকাটি নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সেনাবাহিনীর এক অফিসার সৈন্য টিকে নিবৃত করেন। দৃঢ়তায় ছাত্র-জনতার মিছিল স্লোগানে উত্তাল করে দিয়ে সিএন্ডবি মোড়ে এলে বর্ণালী সিনেমা হলে উর্দু সিনেমা 'রোড টু সোয়াত' প্রদর্শন হচ্ছে। মিছিলটি সেখানে গেলে হল কর্তৃপক্ষ সিনেমাটি প্রদর্শন বন্ধ করে একত্বতা প্রকাশ করে টিকেটের মূল্য ফেরত দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে বিষয়ে মূল্য না দিয়ে দর্শকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি ভুবনমোহন পার্কে আসার পর সভা থেকে আন্দলোন তীব্র করার ঘোষনা দেয়া হয়। স্লোগান উঠে তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। পরদিন ২ মার্চ ছিল হরতাল। ৩ মার্চ হরতাল চলাকালে রাজশাহী টেলিফোন অফিসে সেনাবাহিনী দেখে ছাত্রজনতার মিছিল উত্তেজিত হয়ে উঠে। গুলিবিদ্ধ হয়ে এখানে শহিদ হন রাজশাহী শিরোইল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী নুরুল ইসলাম খোকা যে বিষয়টি আজও অজানা, (তথ্যদাতা সানডাইল কোচিং সেন্টারের পরিচালক হাসানুর)। আহত হয় কলেজিয়েট হাইস্কুলের শিক্ষার্থী আনোয়ার, লোকনাথ হাইস্কুলের শিক্ষার্থী সিদ্দিক সহ অনেকেই। অজ্ঞাত এক যুবক তার গুলিবিদ্ধ শরীরের রক্ত দিয়ে গনকপাড়া মোড়ে তৎকালীন মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকের দেয়ালে লিখেন 'বাংলা স্বাধীন কর-রক্ত স্বাক্ষর'। আহতদের রক্ত দিতে হাসপাতালে ভিড় বাড়তে থাকে। বিকালে ছাত্র জনতা লক্ষীপুর মোড়ে সেনাবাহিনীর একটি অফিসের (পাকিস্তানের সাবেক যোগযোগ মন্ত্রী সবুর খানের আত্মীয়র বাড়ি) দিকে গেলে সেনা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে অনেকে আহত হন। ভুবনমোহন পার্কে সভা চলাকালে সেনাবাহিনীর গুলিতে সদর হাসপতালের মোড়ে রিকশা চালক বিসু শহিদ হন। গুলিবিদ্ধ মিষ্টি ব্যবসায়ী ওমর আলী একাই পেট ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে হাসপাতালে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যান, গুলিবিদ্ধ হন তার শ্যালক বজলু। গণকপাড়ার মোড়ে বেতারের গিটারিস্ট নিজামুল হুদা সহ অনেকে গুলিবিদ্ধ হন। সেনাবাহিনীর কারফিউ ও ঝুঁকি উপেক্ষা করে নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে লেখা 'বাংলা স্বাধীন কর' দেয়ালের সেই লেখাটি দেখতে জনস্রোত সৃষ্টি হয়। আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। পাকিস্তনি সৈন্যরা রাজশাহী কলেজের ছাত্রনেতা চৌধুরী খুরশীদ বিন আলমকে না পেয়ে মুসলিম লীগ সমর্থক খুরশীদ আলমকে ধরে নিয়ে গেলে মুসলিম লীগ নেতা অ্যাডভোকেট আয়েনউদ্দীন তাকে ছাড়িয়ে নেন।
তথ্য সুত্র : বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন ছবি, সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দীন, ছাত্রনেতা চৌধুরী খুরশীদ বিন আলম, গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী।
লেখক, তথ্য সংগ্রাহক,সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী রাজশাহী