ক্যালেন্ডারের পাতার একটি দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি। অনেকের কাছে এই দিনটি অজানা। বিশেষ করে আজকের কিশোর তারুণেরা জানে না ১৪ ফেব্রুয়ারির কথা। কিশোর তরুণদের কাছে দিনটি ভালবাসা দিবস। আমাদের কাছে দিনটি অন্য একদিন। হয়তো একদিন এ দিনটি অন্যদের মতো আমার স্মৃতি থেকেও হারিয়ে যাবে। আজকের ভালবাসা দিবসে আমার সবটুকু হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা সেই একজন মাকে, সেদিনের নির্যাতিত শিশুদের, দিপালী- কাঞ্চনদের, হারিয়ে যাওয়া সঙ্গীটিকে। সেই বাড়িটির সকলকে। ছোট্ট ছেলেটিকে আর যারা সেদিন তাদের কণ্ঠকে সোচ্চার করেছিলেন তাদের। ক্ষমতায় তখন প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ। সারাদেশে ১৪৪ ধারা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ছাত্রদল আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র দল ঢাকায় ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে কর্মসূচি পালন করে। লাঠি চার্জ ও গুলিতে দিপালী কাঞ্চনরা প্রাণ দিল। নির্যাতিত হয় ঢাকা শিশু একাডেমীতে থাকা শিশুরা। রাজশাহীতে এ খবর চলে আসে। এরশাদ সমর্থকরা ঢাকায় ঘটনায় বিব্রত ও হতবাক। রাজশাহীতে উপেক্ষা করা হবে ১৪৪ ধারা। ছাত্র নেতারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। বিকাল হবার সাথে সাথে ছাত্র সমিতির ফুল, কুটি, ছাত্রদল নেতা কামরুদ্দিন হীরা আমার কাছে এলে সকলে মিলে রাজশাহী কলেজের শহিদ মিনারের সামনে গেলাম। এখানে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হল। ছাত্র নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ (সাংসদ), নাসির আহমেদ বিদ্যুত, সারোয়ারী কামাল স্বপন, সিরাজ খান, সালাহউদ্দিন বেবী, রাগিব হাসান মুন্না, মুজিবুল হক বকু, কাউয়ুম, শিবলী, রায়হান, শফিক, টুলু, জেড এম জগলু, শ্যামল, লতিফ, হাবিবুর রহমান বাবু, সেন্টু, শরীফুল ইসলাম বাবু, আজম, মণি, মাসুদ এরকম অনেককের সমর্থনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আমরা হয়ে উঠলাম উত্তপ্ত। আমাদের সাথে কিছুটা সময় থেকে কামরুদ্দীন চলে যেতে চাইলো ছাত্রদলের কর্মসূচীকে সংগঠিত করতে। ও চাইলো আমি ওকে সহযোগিতা করি। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা চাইলেন আমি তাদের সাথে থাকি। অনেকে বললেন যৌথকর্মসূচির কথা। হীরা জানালো তাদের কর্মসূচি একটু দেরীতে হবে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতারা বললেন দেরী করা যাবে না, দেরী হলে কর্মসূচি ব্যর্থ হবে। রাজশাহী কলেজ থেকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিল ভঙ্গ করলো ১৪৪ ধারা। সারা শহর হয়ে গেল থমথমে। বিআইটি, বিশ^বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, ছাত্র মেস, হল, হোস্টেলগুলি হয়ে উঠলো উত্তপ্ত।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলটি বিভিন্ন রাস্তা হয়ে যখন মেডিকেল কলেজের সামনে তখন একজন দৌড়ে গিয়ে খবর দিল রিজভী, হীরা, জিল্লু, মুন্টু, ডিউকদের নেতৃত্বে ছাত্রদল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের মিছিলটি লক্ষীপুর, সিএন্ডবির মোড় হয়ে জেলখানার সামনে আসতেই পুলিশ গাড়ির আলো নিভিয়ে নির্বিচারে লাঠি চার্জ শুরু করল, চারিদিকে অন্ধকার। তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। রাস্তার পাশের এক বাড়ির মা আমাকে রক্ষা করলেন। বাড়িটির ছোট বড় সকলে আমাকে আগলে রাখলেন। গোঙ্গানির শব্দ পেলাম। আস্তে আস্তে শব্দটা থেমে গেল। বাড়িটির সকলে বাড়ির বাইরে বেরুতে বাধা দিলেন। দূর থেকে আসছে স্লোগান আর চিৎকারের শব্দ। ধুলো কাদা মাটি মাখা প্যান্ট শার্ট পরা অবস্থায় সেই মায়ের বাধা উপেক্ষা করে টিটি কলেজে এসে পেলাম, সালাউদ্দিন বেবী, ফুল কুটিদের। লক্ষীপুর মোড়, মেডিকেল কলেজের সামনে তখন রণক্ষেত্র। ওদিকে যেতে সালাহউদ্দিন বেবী বাধা দিলেন। ফুল কুটিকে নিয়ে হাই মাদ্রাসার দিকে আসার সময় দেখা পেলাম লতিফ ও শ্যামলের সাথে। ওরা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে আর আমরা পূর্বদিকে। এ অবস্থায় দুএকটি কথা। পরিস্থিতি উত্তেজনাকর। রাজশাহী কলেজের সামনে সাইকেলে করে আসা ছোট্ট একটি ছেলের ডাকে ফিরে তাকালাম। ও জানালো আমাদের ও খুঁজছে। জানালো জেলখানার সামনে যে ছেলেটি .................। এই কথা বলে সে সাইকেল নিয়ে সরে গেল। আমরা হীরা, রিজভীর সাথে যোগাযোগ করলাম। জানালাম জেলখানার সামনের ঘটনা। পরের দিন রাজশাহী বিদ্যুৎ অফিসের সামনে মিছিলে থাকা এক ছাত্রনেতার সাথে দেখা। তিনি জেলখানার সামনের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলেন না। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোন সংগঠন থেকে মিছিলে গিয়েছিলাম। বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম, কোন সংগঠন থেকে নয়, প্রতিবাদ করতে মিছিলে গিয়েছিলাম। আমার কথাটি তার পছন্দ হয় নি। কিছুটা রাগ করে বললেন, আমার যদি কিছু হতো, তাহলে কিভাবে আমাকে ট্রেস করতেন। আমাকে রেখে উনি চলে গেলেন। হঠাৎ করে একদিন তার সাথে দেখা, বললেন তিনি, জেনারেল এরশাদের ছাত্র সংগঠনকে সংগঠিত করছেন। তার সাথে থাকলে আমার ভালো হবে। রাজী হয়নি। আবারও উনি রাগ করে চলে গেলেন। তার সাথে আর দেখা হয়নি। হয়তো বড়সড় কিছু হয়ে গেছেন। জেলখানার সামনের ঘটনাটি আজও অজনা। খবর দিতে আসা ছোট্ট ছেলেটি আজ কোথায় জানি না। জেলখানার সামনের রাস্তা, সেই মা, সেই বাড়ির সকলে আমার খুব কাছের। সেই মা এখন নেই। রাস্তা ও বাড়িটির পরিবর্তন হয়েছে। বাড়ির ছোটরা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি স্মৃতিগুলি আমাকে সেখানে যেতে ডাক দেয়। খুঁজি ফিরি সেদিনের আন্দোলনে থাকা মুখগুলিকে। যাদের অনেকদিন দেখিনি।
লেখকঃ- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজশাহী।