রবিবার, অক্টোবর ১৩, ২০২৪
Logo

২১ এর কথা নিয়ে বিচার প্রতি হাবিবুর রহমান

Justice Habibur Rahman
Bijoy Bangla

বিচার প্রতি হাবিবুর রহমান

published: 21 February, 2024, 04:50 AM

২১ এর কথা নিয়ে বিচার প্রতি হাবিবুর রহমান
ভাষা আন্দোলনের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাষা সৈনিক, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, সাবেক প্রধান বিচারপতি, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও রাজশাহী কলেজের প্রাপ্তন ছাত্র মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

আমার জন্ম এক রাজনৈতিক পরিবারে। আমার আব্বা প্রথমে আনজুমান এবং পরে মুসলিম লীগ আন্দোলনের সাংগঠনিক পর্যায়ে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলা মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত। আমাদের বাড়িতে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর আনাগোনা ছিল বরাবর। তখন আমার ছেলেবেলা। একবার সুভাষ বসু এলেন আমাদের জঙ্গীপুর শহরে। সেবার মওলানা আজাদও এসেছিলেন মনে হচ্ছে। বহরমপুরে মুসলিম লীগ কনফারেন্স হলো। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতা শুনলাম সেই প্রথম। 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের সময় স্থানীয় ফৌজদারি কোর্টের সামনে পাঠান পুলিশ লাঠিচার্জ করে শোভাযাত্রা ভেঙ্গে দিলো। আমার দুজন সহপাঠী জেলে গেলেন। বলাবাহুল্য, সে আন্দোলনে আমরা কোনো অংশগ্রহণ করিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আব্বা ন্যাশনাল ওয়ার ফ্রন্টের সাবডিভিশনাল লিডার ছিলেন। সেই যুদ্ধ যখন বামপন্থীদের দ্বারা 'জনযুদ্ধ' হিসেবে আখ্যায়িত হলে তখন থেকে আমাদের বাড়িতে ফ্যাসিবিরোধী প্রচার পুস্তিকা আসতে থাকে। বিভিন্ন ধরনের মতাদর্শের পত্রপত্রিকা আমি সাগ্রহে পড়তে শুরু করলাম। মাসিক 'সোভিয়েত রাশিয়া'র ক্রোড়পত্র থেকে একবার রুশ ভাষা শেখার চেষ্টা করলাম। নিজের নাম লেখা ছাড়া সে বিদ্যা বেশি দূর এগুলো না। এই পরিবেশে আমার বয়সের তুলনায় অনেক বড়ো ও গুরুগম্ভীর প্রশ্ন আমার মনে তোলপাড় করতে লাগলো। প্রতিদ্বন্দ্বী পেলেই তর্কে মেতে উঠতাম। একবার এক সভায় আমার আব্বা সভাপতিত্ব করছিলেন। আমি হঠাৎ দাঁড়িয়ে মুসলিম লীগের কোনো কোনো নীতির সমালোচনা করে বসলাম। যথাযথ সৌজন্য প্রকাশ করে আব্বা অবশ্য জবাব দিলেন। পিতা-পুত্রের বাগযুদ্ধে উপস্থিত শ্রোতামণ্ডলী বেশ কৌতুক অনুভব করলেন। ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলাম আই.এ পড়ার জন্য। তখন পার্কে, ময়দানে ও ইন্সস্টিটিউটের উল্লেখযোগ্য প্রতিটি সভায় উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম। লেখাপড়ার জন্য সময় পেতাম কম। জিন্নাহ, নেহরু, আবুল হাশিম, বঙ্কিম মুখার্জী, সত্যেন 'মজুমদার, হীরেন মুখার্জী প্রমুখ খ্যাতনামা বাগ্মীর বক্তৃতা শুনতাম অবাক বিস্ময়ে। সৌধপুর আশ্রমে একবার গান্ধীকে দেখতে গেলাম। সেদিন ছিল তার মৌনব্রতের দিন। গান্ধীর বক্তৃতা আমার আর শোনা হল না। রশিদ আলী দিবসে আহতদের জন্য কলকাতা মেডিকেল কলেজে রক্তদান করতে গেলাম। তখন আমার ওজন ছিল ৮০ পাউন্ড। ডাক্তার আমাকে দেখে হাসলেন এবং আমি লজ্জা পেলাম। শেষ পর্যন্ত আমার কয়েক সিসি রক্ত গ্রহণ করায় আমি বিব্রত অবস্থা থেকে উদ্ধার পেলাম। সে সময় আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করতো আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের আদর্শ। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পেই পাকিস্তানের আন্দোলন- সেই যুক্তি সেদিন যেমন ছিল চিত্তাকর্ষক তেমনি গ্রহণযোগ্য।

১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টের পর সবচেয়ে ঘৃণা করতে শিখলাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে। অন্য কোনো অবস্থায় মানুষকে আমি এতো অসহায় দেখিনি। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হিসেবে মুর্শিদাবাদ জেলা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় আব্বা খুব দুঃখ পেয়েছিলেন। খুলনার বিনিময়ে মুর্শিদাবাদকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার আব্বার গোপন চেষ্টা অন্তভুক্ত ব্যর্থ হয়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করেন এবং বহরমপুর জেলে বেশ কয়েকদিন আটকে রাখেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আব্বা কংগ্রেসে যোগদান করার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৪৮ সালে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে তিনি রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এর পূর্বেই ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে আমি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হই বি.এ. পড়ার জন্য। রাজশাহী কলেজের ফিজিক্স বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে রেডিও সম্প্রচার থেকে জিন্নাহ সাহেবের সেই ভাষণ আমি শুনি যখন তিনি একতরফভাবে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সেদিন আমি মনে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। সর্বজনসম্মানিত দেশনায়কের হাতে আমার প্রিয় আদর্শ আত্মনিয়ন্ত্রণের এমন অবমাননা আমি আশা করিনি। কখন আমার মনের গহনে (হয়তো সমমনা অনেকের অন্তরেও) একটা বিশিষ্টতাবোধ অগোচরে সঞ্চারিত হয়ে গেলো এরপর বাংলা ভাষাবিরোধী প্রতিটি উক্তি ও আচরণ সেই বিশিষ্টতাবোধকে পুষ্টি দান করতে থাকে। সেই স্বাতন্ত্রবোধ কখন সিদ্ধি লাভ করে আত্মআবিষ্কারে ব্যাপৃত হয় তা আমার খেয়াল নেই। শুধু দেখলাম, রাজহংসের শুভ্র পালকে যেমন কালিমা লেপন সম্ভব হয় না, তেমনি সেই বিশিষ্টতাবোধের বিরুদ্ধে কোনো প্রচার বা প্রয়াস সফলকাম হলো না। রাজশাহী কলেজে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের আহ্বানে হরতাল পালিত হয়। সেই ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সেদিন আমরা পিকেটিং করি। বাংলা ভাষার দাবির প্রশ্নে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, শিক্ষিত জনসমাজেও তেমন কোনো বিশেষ আগ্রহ সেদিন পরিলক্ষিত হয়নি। যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশেষভাবে চর্চা করতেন এবং পরে যারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধিকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন তাদের অনেকের মধ্যে কোনো উৎসাহ সেদিন দেখিনি। দু'একজনকে কোনোমতেই সেই ধর্মঘটে যোগদান করাতে আমরা সক্ষম হলাম না। সে সময় মুহম্মদ সুলতান, গোলাম রহমান ও একরামুল হক ছাত্ররাজনীতিতে অত্যন্ত তৎপর ছিলেন। আমার কোনো বিশেষ ভূমিকা বা প্রভাব ছিল না। এমএ পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে। ঢাকায় আসি ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর কি ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ছাত্রসমাজে যখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠতো তখন চুপচাপ না থেকে আমি সরাসরি সাড়া দিতাম। উপনিবেশবাদ, ভিয়েতনাম, বর্ণবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, ছাত্রদের দাবি-দাওয়া ইত্যাদি ছোটবড়ো সব ব্যাপারে আমি নিজস্ব একটা বক্তব্য রাখার প্রেরণা অনুভব করতাম। ছোটখাটো সব আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে না পারলে নিজেকে অপরাধী মনে হতো। ফরাসি শব্দ 'অঁগাজে' (বাংলা শব্দ নিয়োজিত না নিবেদিত হবে?) বলতে যা বোঝায় মনের অবস্থা ছিল তাই। মনে হতো, যেন সারা পৃথিবীটা আমাকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করছে। সকল সমস্যার আশু সমাধান যেন সন্নিকটে। কল্যাণকর সমাজ প্রতিষ্ঠার একটা অস্পষ্ট ধারণা মাথার ভেতরে পাক খেতো। নিজেকে প্রগতিবাদী বলে পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করতাম। কিন্তু আমার সেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে দীক্ষা পেলো না। তৎকালীন কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য আমি কোনো বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করলাম না। একটি অপরিণত ও অতৃপ্ত রাজনৈতিক চেতনা আন্দোলনের তাৎক্ষণিকতায় মেতে উঠলো।

এই ভাসমান অবস্থা কেবল আমার একার ছিল তা নয়। আমার সমসাময়িক বহু বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীর মধ্যে অনেকেই সেদিন কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানেরই সদস্য ছিল না। পরে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের চেষ্টায় ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। আমার তখন ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে এবং কর্মজীবনে আমি অধ্যাপনা শুরু করেছি। সেদিন কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজে আমার ও আমার বন্ধুবান্ধবদের একটা সীমিত প্রভাব ছিল। এই প্রভাবের সৃষ্টি হলো ইউনিয়নের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ১৯৫১ সালে আমাদের বন্ধুবান্ধবরা ফজলুল হক হল ইউনিয়নের নির্বাচনে জয়ী হন। আমি সলিমুল্লাহ হলের সহসভাপতি নির্বাচিত হই। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সাহেব নির্বাচিত হন সাধারণ সম্পাদক। নিখিল পাকিস্তান ছাত্রলীগ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের যোগসাজশে আমার পক্ষে হল ইউনিয়নের বাজেট পাস করা সম্ভব হয়নি। আমার কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দির মধ্যে প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন সাহেব যেদিন ঘোষণা করলেন, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তার পরের দিনই পুরোনো আর্টস বিল্ডিঙের আমতলায় তড়িঘড়ি একটা সভা করে সেই ঘোষণার আমরা নিন্দা করি। মনের রাগে ও দুঃখে সেদিন আমি বলেছিলাম, 'শুনেছি ফ্যাসিস্ট ইতালিতে স্লোগান দেওয়া হতো- মুসোলিনি কোনোদিন ভুল করে না। দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে অনুরূপভাবে আমাদের ওপর একটা সবক চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, জিন্নাহর কথাই অভ্রান্ত। তার নড়চড় হবে না।' জিন্নাহ সাহেবকে কায়েদে আযম হিসেবে উল্লেখ না করায় দু'একজন ছাত্র মারমুখো হয়ে প্রতিবাদ করে ওঠে। কিন্তু আমার গায়ে কেউ হাত তোলেনি সেদিন। সে সময়ে ছাত্রদের মধ্যে মতানৈক্যের জন্য হাতাহাতির কোনো নজির ছিল না। কোনো রাজনৈতিক নেতার উল্লেখ করার সময় তার পিতৃদত্ত নাম উচ্চারণ করাই আমার কাছে বরাবর সমীচীন মনে হয়েছে। শিগগিরই ঘটনার দ্রুত পরিবর্তন ঘটলো। ২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কি রকম একটা বিপদ-সংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারি গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ পরিবেশনটি। যখন শুনলাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। মনে হয়েছিল, আমাদের আন্দোলনকে কারা যেন বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। রাত নটা- দশটার সময় আমরা সাত/আটজন বন্ধু মিলিত হই ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে। যতোদূর মনে পড়ে সেখানে মুহম্মদ সুলতান, আবদুল মমিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দিন শহুদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি যে, ঐ বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন। আমি এখন তার চেহারা মনে করতে পারছি না। ঐ সভায় একটা প্রশ্ন ওঠে, বিনা প্রস্তুতিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে অযথা শক্তিক্ষয় করা হবে কিনা। মুসলমান ছাত্রসমাজে আইন ভাঙার তেমন কোনো রেওয়াজ ছিল না বললেই চলে। কলকাতার রশিদ আলী দিবস ও আরো অন্যান্য আন্দোলনের সময় আমি ১৪৪ ধারার বিধি-নিষেধ অমান্য করতে দেখেছিলাম। সেদিন রাতে অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে এবং আন্দোলন বন্ধ করা চলবে না। আমরা কেমন করে আইন অমান্য করবো তার কোনো স্পষ্ট ছবি তখন আমাদের মনে ছিল না। তরুণ মনে এই আশা ছিল যে, একবার ১৪৪ ধারা ভাঙলে বেশির ভাগ ছাত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য। পরের দিন সকালে আমি আর মুহম্মদ সুলতান জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্কুলে গেলাম ধর্মঘট কেমন চলছে দেখার জন্য। নওয়াবপুরে আওয়ামী লীগের অফিসে একবার ঢু মেরে দেখলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত হবে কিনা এই নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। শহরে তখন একটা উত্তেজনার ভাব। আর্টস বিল্ডিঙে ফিরে এসে দেখি মিটিং শুরু হয়েছে।


ভাষা আন্দোলনের একটি মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ভাষা সৈনিক, তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, সাবেক প্রধান বিচারপতি, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও রাজশাহী কলেজের প্রাপ্তন ছাত্র মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

গাজীউল হক দুহাত তুলে সভা পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি শামসুল হক সাহেব নিজের অনেক কথা বলে ১৪৪ ধারা ভঙের বিরোধিতা করলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কনভেনার আবদুল মতিন সাহেব অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে প্ল্যান দিলেন যে, একসঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে পারে। সুতরাং ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দল এগিয়ে যাবে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য। গাজীউল হক সেই প্ল্যানকে সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করলেন। উত্তেজনায় জমায়েত ফেটে পড়লো। ভাইস চ্যান্সেলার মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব সকলকে একবার শান্ত করার চেষ্টা করলেন। আইন ভাঙার প্ল্যানে এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে, অনেকে ভালো করে বুঝতে পারলো না কি করতে হবে। আগের রাতে যাদের মধ্যে আইন ভাঙার ব্যাপারে একটু ইতস্তত ভাব ছিল, দেখলাম তাদের সেই দোটানা ভাব কখন কেটে গেছে। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ছাড়বে বলে অনেকে রুমাল ভিজিয়ে নিলো। ভিড়ের মধ্যে আমিও আমার রুমালটা ভিজিয়ে নিলাম। তার জন্য মনে কেমন যেন একটা লজ্জা হচ্ছিল। প্রক্টরের গেটের কাছে ক্রমশ ভিড় জমেছে, কিন্তু রাস্তায় বের হওয়ার কারো কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব। কেউ কারো কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখলাম, আমাদের আগের দিনের প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাওয়ার যোগাড়। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমরা কয়েকজন যদি গেটের বাইরে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙি তবে কেমন হয়! আমাকে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে এমন কোনো পূর্ব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে আমর মনে নেই। আমি যেহেতু আগের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙার ওপর জোর দিই সেজন্য বন্ধুদের একটা প্রত্যাশা ছিল যে, আমি প্রথম ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে যাবো। যারা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে এলেন মুহম্মদ সুলতান তাদের নাম লিখে নিলেন। আমি তাকে বললাম, ‘তুই আমার পক্সক্ষীরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম কয়েকজনকে সঙ্গে করে। তখন বেলা সোয়া একটা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের বের হচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার একধারে ঘেরাও করে রাখে। আর্টস বিল্ডিঙের উপর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে দেখলাম আমাদের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধ দোতলা থেকে আমাদের লক্ষ্য করছেন। আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্যান্য ছাত্র গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করলো তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ ট্রাকে তুলে নিলো। ট্রাকটা যখন তেজগাঁও-এর দিকে চলতে শুরু করলো তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোনো মজা পুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’ ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়ার মানসিক উত্তেজনা কিছু কমলো, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকলো। অবশেষে আমাদেরকে তেজগাঁও পুলিশ স্টেশনে হাজির করা হলো। ছোট একটা হাজতঘরে আমাদের ১০-১২ জনকে একে সঙ্গে আটকে রাখা হলো। হাজতঘরে আরো দু একজন আসামি ছিল। ঘরে প্রস্রাবের গন্ধে টিকতে না পেরে আমরা চেঁচামেচি করি। পরে আমাদের বড়ো একটি খোলা ঘরে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। রাতে দারোগা সাহেবের অফিস-ঘরে মাটিতে শোয়ার জন্য ঢালাও বন্দোবস্ত করা হলো। পোড়া খিচুড়ি খেয়ে আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ রাত তিনটায় ঘুম ভাঙলো। ফিস ফিস করে কানাকানি করছে সবাই। শুনলাম ঢাকায় গুলি চলেছে। ধীরে ধীরে কথাটা প্রত্যেকের কানে পৌঁছলো। অল্প শক্তির একটি ঘোলাটে বিজলি বাতির আলোয় বড়ো ঘরটার আবহাওয়া ক্রমেই ভারী হয়ে উঠলো। সকালে আমাদের পুলিশ ভ্যানে করে ঢাকা কোর্টে নিয়ে যাওয়া হলো। রাস্তা একবারে জনশূন্য। সব খাঁ খাঁ করছে। কোর্টে পৌঁছে দেখি কোর্ট চত্বরে লোকে গিস গিস করছে।

পুলিশ আর সেনাবাহিনী চারধার ঘিরে রেখেছে। জনতার মধ্য থেকে কেউ কেউ আমাদের জন্য কিছু খাবার এনে দিলেন। বন্ধুদের পরামর্শে অবাঙালি পুলিশ সৈন্যদের উদ্দেশে উর্দুতে কয়েক মিনিট বক্তৃতা করার চেষ্টা করলাম। কয়েকখানা 'মর্নিং নিউজ' পত্রিকাও পোড়ানো হলো। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কোর্টে হাজির না করেই আমাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নেওয়া হলো। পরে শুনলাম খুনের চেষ্টা, মারাত্মক অস্ত্রস্বস্ত্র সহকারে দাঙ্গা, কর্তব্যরত সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে হামলা ইত্যাদি অভিযোগে আমাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিচারাধীন কয়েদির নম্বর ৪৭৭ হলো আমার পরিচয়। বেশ কয়েকদিন পর জেলের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আমাদের হাজির করা হলো। ‘আমরা এই বলে সাফাই দিলাম, ১৪৪ ধারা অন্যায়ভাবে জারি করা করা হয়, সেই ভেবে আমরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করি’। যতোদূর মনে পড়ছে আমি ১১ মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে আসি। জেলে আমাদের কোনো ক্লাস দেওয়া হয়নি। একটা লম্বা ঘরে ২৭-২৮ জন মিলে আমরা রাত কাটাতাম। আমাদের প্রত্যেককে দুটো করে কম্বল দেওয়া হয়। আমার এক পার্শ্বে থাকতেন এস এ বারি, এ টি আর এক পাশে নেয়ামাল বসির। ইকবালের একটা কবিতার বই থেকে নেয়ামাল বসির কবিতা পড়ে শোনাতেন। দুএকবার আলোচনা চক্রের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সেই আবহাওয়ায় তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। জেলের মধ্যে নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হতো। ‘নুরুল আমিন- গদি ছাড়’ এই স্লোগানটা তখন আমরা তেমন পছন্দ করতাম না। আমাদের কেমন একটা আশঙ্কা হতো যে, ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কেউ আবার বাংলা ভাষার আন্দোলনকে বিপথে চালিত না করে। পুলিশের ভয়ে লোক এতো অতিষ্ঠ ছিল যে, বন্ধু- বান্ধব কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেননি। রাজশাহী থেকে আব্বা এলেন দেখা করার জন্য। জেলখানার কম্বল গায়ে দিয়ে দাঁড়িভরা মুখ নিয়ে যখন তার সামনে গরাদের এ পাশে দাঁড়ালাম তখন দেখি তার চোখ ছল ছল করছে। আমি অত্যন্ত বিব্রতবোধ করলাম। পিতা-পুত্রের মধ্যে প্রায় কোনো কথাই হলো না। কারাবরণ কথাটার মধ্যে একটা ব্রত উদযাপনের ভাব আছে, আত্মনিগ্রহ ব্রতের। জেল আমার ভালো লাগেনি। জেল থেকে বেরিয়ে আমি রাজশাহী যাই। কয়েক সপ্তাহ পরে ঢাকায় ফিরে আসি। ল'য়ের কয়েকটা ক্লাস তখনো বাকি ছিল। পয়লা মে আমার শিক্ষক, প্রফেসর হালিম সাহেবের আমন্ত্রণে ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী লেকচারার পদে যোগদান করি। আমার হাজত বাসের কথা উল্লেখ করে ভাইস চ্যান্সেলরের কান ভারি করা হয়। কোনো কোনো সহযোগী আমাকে বিশেষ বর্ণে রঞ্জিত করে ভাইস চ্যান্সেলরের কাছে অভিযোগ করেন। ৪ মে প্রফেসর হালিম আমাকে ডেকে সব কথা বললেন। তাকে চিন্তান্বিত দেখে আমার খারাপ লাগলো। আমি বললাম, ‘আমার জন্য যদি আপনার বা ইউনিভার্সিটির কোনো অসুবিধা হয়, তবে আমি পদত্যাগ করছি’। অনুরূপ ভাষায় তাকে একটি পদত্যাগপত্র দিলাম। ভাইস চ্যান্সেলর ড. মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলেন। এরপর বিচ্ছিন্নভাবে কয়েক বছর সিরাজগঞ্জ কলেজ, জগন্নাথ কলেজ, আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও রাজশাহী কলেজে ইতিহাসে অধ্যাপনা করি।

১৯৫৬ সালে স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ড যাই ইতিহাসে অনার্স পড়তে। ইতিমধ্যে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। আরবি, উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি-এই চার ভাষা নিয়ে আমার প্রাথমিক পাঠ শুরু। দুসরি বা তিসরি কেতাবের পর পাঠ্য তালিকা থেকে উর্দু খসে পড়ে। আমার আব্বা বিএ পর্যন্ত সংস্কৃতি পড়েন। তাই নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিলার হিসেবে যখন কোনো উর্দু সার্কুলার বা চিঠি পেতেন তিনি আমার শরণাপন্ন হতেন। আমি উর্দু লেখা চিঠি মর্মোদ্ধার করতে না পেরে বিরক্ত হতাম। মনে হতো আব্বার ওপর কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ দপ্তর যেন অভদ্রভাবে একটা জুলুম করছে। বস্তুত নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা ভারতীয় মুসলিম সমাজ উর্দু বনাম হিন্দির প্রশ্নে বরাবর উর্দুর পক্ষে ওকালতি করে এসেছিল। আমাদের দেশে মক্তব-মাদ্রাসায় ও ওয়াজ মাহফিলে উর্দুর বেশ প্রচলন ছিল। কোনো কোনো সময় বইয়ে লেখা হতো, সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের ভাষা উর্দু। ভারতীয় মুসলমান সমাজের যখন নিজস্ব ‘ওতন’ বা বাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন স্বাভাবিকভাবে নেতাদের মনে হয়েছিল ‘কওমি জবান’ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের কাছে জিন্নাহ সাহেবের একরোখা মন্তব্যের একটা যৌক্তিকতা ছিল বই কি! জিন্নাহ সাহেব বা নাজিমুদ্দিন কেউই ভালো উর্দু বলতে পারতেন না। তাদের চেয়ে এ দেশের অনেক মওলানা বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ভালো উর্দু বলতে পারতেন। পূর্ববাংলায় সহস্রাধিক মক্তব-মাদ্রাসার বহু মৌলভী- মওলানা ও তালবে-এলেম উর্দু ভাষায় মোটামুটিভাবে পারদর্শিতা লাভ করেন। পাকিস্তানের পশ্চিম অঞ্চলে বাংলা ভাষার কোনো চলুই ছিল না। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের অনেক সময় তাদের পশ্চিমা সমকক্ষদের সঙ্গে ইংরেজির চেয়ে ভাঙা উর্দুতে কথা বলতে স্বস্তিবোধ করতে দেখা যেতো। এমন অবস্থায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার চিন্তা কুরা মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের পক্ষে অস্বাভাবিক ছিল না। দুই অঞ্চলের ভৌগোলিক ব্যবধানের ক্ষেত্রে সেতু বন্ধন হিসাবে লেঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার ভূমিকায় উর্দুর একটা স্থান হয়ত ছিল কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ালো মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি। বস্তুত  বঙ্গ প্রদেশের ভোটেই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব নিলেন পশ্চিমা মুসলমান নেতৃবৃন্দ এবং দেশপ্রেমের একমাত্র দাবিদার সাজলেন অধিকারীর বেশে। রাষ্ট্রের মঙ্গল কামনা ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার সৃষ্টিকর্তা যেন তাদের হাতে সঁপে দিয়েছেন। বিত্তবান ও প্রভাবশালী পশ্চিমা নেতৃত্বকে কেমন যেন সহজে মেনে নিলো পূর্বাঞ্চলের মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। এমনিতেই এদেশে সে পশ্চিমা ব্রাহ্মণই হোক বা মওলানাই হোক, তার কদর বেশি। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দের মুরুব্বিয়ানার সামনে পূর্ববাংলার নেতৃবৃন্দের হীনমন্যতায় তরুণ ছাত্রসমাজ হলো অত্যন্ত মর্মাহত। পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ কথায়-বার্তায় ও আচরণে এমন ভাব প্রকাশ করতেন, এদেশের মুসলমান সত্যিকারের মুসলমান নয়, এখানকার মানুষ কোনোদিন স্বাধীন ছিল না, এরা হিন্দু দেবদেবী পূজা করে, হিন্দুদের কাছে থেকে সবক নেয় এবং তাদের কথায় ওঠে-বসে।

পূর্ববাংলার মানুষদের বিরুদ্ধে এক নিরবচ্ছিন্ন চরিত্রহনন চলতে থাকলো। কাজেকর্মে মুসলিম সৌভ্রাত্রের কথা ফাঁকা ও অসার শোনালো। এক সময় এ দেশের একজন গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুন এক চরম অসৌজন্যমূলক উক্তি কর বসলেন, ‘এ দেশের মুসলমানদের নাম হিন্দুর মতো, এ দেশের মুসলমানরা মুসলমানি করে না।’ তরুণ পূর্ববাংলার সবচেয়ে খারাপ লাগলো, যখন দেখা গেলো নেতৃস্থানীয় কোনো নেতা পশ্চিমা মুরুব্বিয়ানার তেমন কোনো প্রতিবাদ করলেন না। আমাদের নেতৃবৃন্দ জানালেন না, কখন তারা হারিয়ে  ফেলেছেন যুব সমাজের আস্তা। রাজনৈতিক উৎপীড়ন বা অর্থনৈতিক শসনের তাৎপর্য মানুষকে বোঝাতে হয়। সময় লাগে তাকে উদ্বুদ্ধ করতে। কিন্তু মানুষের আত্বমর্যাদা যখন আহত হয় তখন সে বিক্ষুদ্ধ হয় সহজেই। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত এদেশের যুব সমাজের আত্মমর্যাদা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এক নিদারুণ আঘাত হিসেবে দেখা দেয়। ক্ষোভ, আবেগ, বুদ্ধি ও যুক্তির একত্র সমাবেশে দুর্বার হলো সেই আন্দোলন। একটা ঔপনিবেশিক নিপীড়নের অবস্থা সৃষ্টি হলো। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দিলে আমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যাবো এবং চাকরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অন্যদের কাছে হেরে যাবো, সে ধরনের ঠাণ্ডা মাথার যুক্তি তখন আমরা তুলতাম না। সুইজারল্যান্ড, কানাডা, বেলজিয়াম ইত্যাদি বহু রাষ্ট্রভাষাভাষী রাষ্ট্রের কথা আমাদের আলোচনায় উল্লেখ পেতো বটে, তবে বেশির ভাগ সময় বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনো যুক্তি প্রর্দশন তখন তরুণ মনে বাহুল্য মনে হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার এক বিদেশী অধ্যাপক পাকিস্তানে উভয় অঞ্চলের জনসংখ্যার হিসাব করে ভাষা আন্দোলনের ওপর মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইট ইজ সিম্পল ম্যাথমেটিক্স’। বাংলা ভাষার দাবির পিছনে এমন একটা সহজ ও বোধগম্য যুক্তি ছিল যে, কোনো অপপ্রচার দ্বারাই তা খণ্ডন করা সম্ভব হলো না। আবেগে, বিক্ষোভে ও যুক্তিপ্রমাণে সেই আন্দোলন এমনই দুর্বার হয়ে দাঁড়ালো যে, আইনের কোনো বাধা তা মানার কথা নয়। তাই ৪ বছর পরেই রাষ্ট্রভাষার দাবি দেশের সংবিধানে স্বীকৃতি পেলো। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েই শেষ হয়ে গেলো না। জাতির প্রতিটি প্রশ্ন, আশা ও আকাক্সক্ষা এর পরও আবর্তিত হতে থাকলো একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি অনেক সময় বহুবাচনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বিরোধের সৃষ্টি করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে অবশ্য সে ধরনের কোনো বিরোধের প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। তবু 'শিশু' রাষ্ট্রের সংহতির দোহাই যারা পারতেন তাদের মধ্যে একটা আশঙ্কা দেখা দেয়। সেদিন ভিন্ন কণ্ঠে একটি ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যেতো ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’, রাষ্ট্র ভাসানো বাংলা চাই না।’ এই আশঙ্কায় আরবি হরফে বাংলা চালু করার এবং বাংলা ভাষাকে ‘শুদ্ধ’ করার একটা চেষ্টা মাজে মাঝে দেখা দিতো। কিন্তু সকল প্রচেষ্টাই শেষ পর্যন্ত কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা বা গুরুত্ব লাভ করতে পারলো না। সবই হলো পণ্ডশ্রম। অবশেষে, যে রাষ্ট্র নিয়ে হিতৈষীদের এতো দুর্ভাবনা, ইতিহাসের ঘটনাক্রমে দুদশকের মধ্যে কালস্রোতে ভেসে গেলো সেই রাষ্ট্র। তথ্যসূত্র! ‘অবসর’ দৈনিক ভোরের কাগজ ২১ ফেব্রুয়ারী ১৯৯৮।

সাংবাদিক মাহাতাব চৌধুরীর সাথে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের আলাপচারীতা ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০০০।

মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশে ২১ পালনের দিন কিছু ঘটনা আমার মতো অনেকেই পীড়া দেয় এর কারন সম্পূর্ণ অসচেতনতা। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন নিয়ে কখা উঠলেও এইটা কার্যকারী করতে আমরা ব্যার্থ হয়েছি পরিপক্ততার অভাবে। ২১ কে আর্ন্তজাতিক সন্মানিত করতে যারা প্রতিষ্ঠা চালান তারা যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব। মাতৃভাষার জন্য আমাদের দেশে রক্ত ঝড়েছে প্রান গেছে এই সত্য এইটা যেমন সত্য তেমন পাশের দেশের আসাম রাজ্যে এরকম আন্দলনে রক্ত ঝড়ে প্রানও যায় তাদের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। মাতৃভাষা অস্তিত্বের পরিচয় এবং অন্তরের বিষয় তাই প্রতিটি মাতৃভাষাকে সম্নান করা উচিৎ। শুদ্ধ করে মাতৃভাষা ব্যবহারে গর্ববোধ আছে (আঞ্চলিকতার কথা বলছি না) মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে অন্য ভাষা চর্চা করা জানা অপরাধের কিছু নয়।

google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0