শনিবার, ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
Logo
Subedar Major Shahid Shawkat Ali

জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশের সময়: ২৭ মার্চ, ২০২৪, ০৯:৫৬এএম

জাতীয়  বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী
জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষনার ম্যাসেজ-অডিও 

১৯৭১সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর সকণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা ও ম্যাসেজটি ঢাকার ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস হেডকোয়ার্টার থেকে ঝুকি উপেক্ষা করে যিনি ব্লাকসেটের মাধ্যমে বাইরে প্রেরণ করেন। তিনি জাতীয় বীর রাজশাহীর গর্ব, সাহসী মানুষ, বিপ্লবী ব্যক্তিত্য সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী। ২৫মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকার ঝুঁকি উপেক্ষা করে সাহসী ছাত্রনেতা কাজী আরিফ বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অডিও ও ম্যাসেজ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) পিলখানার হেডকোয়ার্টারের আজিমপুর গেটে অপেক্ষায় থাকা সিরাজুল ইসলামের কাছে পৌছে দিলে তিনি সতর্কতার সাথে সেটি হস্তান্তর করলেন  সুবেদার মেজর শওকত আলীর কাছে। সূত্রের ধারণা এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে আরো কয়েকজনের ভূমিকা থাকতে পারে। রাত এগারোটার দিকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার নেসার আহমেদের বাড়ির দিক থেকে ট্রেসার সেল ফাটার সাথে সাথে সেনাবাহিনী ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ব্যারাক, কোয়ার্টার গার্ড দখল করে নেয়। সুবেদার মেজর শওকত আলীর দেয়া পরামর্শে সিগন্যাল কোরের বাঙালি সৈনিকেরা ছাদে থাকায় রক্ষা পেয়ে যায়। সুবেদার মেজর শওকত আলী সাথে থাকা সিগন্যাল ম্যান আব্দুৃল মোত্তালিব কে নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠলেন।

তিনি মেটোরেনা এসিবিসি-৩ সেটে (ব্লাক সেট) ভয়েস অপসন ও টিজি অপসনের মাধ্যমে তার কাছে আসা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার অডিও ও মেসেজটি “ÒThis is may be my last massage, from today Bangladesh independent." I call upon the people of Bangladesh where ever you might be and whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved."  বাইরে প্রেরন করলে রাত সাড়ে এগারোটায় চট্টগ্রামের সিগন্যাল ম্যান আবুল খায়ের তার সেটে এটি পেয়ে কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে দেয়া মাত্রই তিনি সংশ্লিষ্টদের কাছে সেটি প্রেরণের ব্যবস্থা করলেন। চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন বিওপি ও ওয়্যারলেস সেন্টার এটি সংরক্ষণ করে সংশ্লিষ্টদের কাছে তা জানাতে ভূমিকা রাখতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর স্বকণ্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণার অডিও ও ম্যাসেজটি পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে ধরা পড়ে গেলে তারা রাত একটার দিকে সুবেদার মেজর শওকত আলী ও সঙ্গে থাকা আব্দুল মোতালেবকে এগারো নম্বর ব্যারাকে নেবার পর সেখান থেকে ঢাকা মোহাম্মদপুর শরীরচর্চা কলেজের টর্চার সেন্টারে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করতে থাকে। সেখানে তারা সহকর্মী সুবেদার মোল্লা, সুবেদার জহুর মুন্সি, সুবেদার আব্দুল হাই, সুবেদার আইয়ুবসহ অন্যদের বন্দি করে নিয়ে এসে নির্যাতন করতে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সুবেদার জহুর মুন্সি, সুবেদার আব্দুল হাইকে পেরেক দিয়ে দেয়ালে গেঁথে দিয়ে তাদের উপর নির্যাতন চালাতে থাকলে , তারা এভাবে শহিদ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। ধরা পড়ে গিয়েও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান সিগন্যাল ম্যান আব্দুল মোত্তালিব। 

বিভিন্ন টিজি-অপশন থেকে ম্যাসেজটি সংগ্রহ করার পর প্রচারপত্র আকারে বিলি করা হয়। চট্টগ্রাম ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের সিগন্যালম্যান মিজানুর রহমান, ঠাকুরগাঁও ৯নং উইং এর সিগন্যালম্যান শামসুল হক, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৬নং উইং এর অপারেটর ফারুক সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি জানাতে ভূমিকা রাখেন। পাবনা জেলার তৎকালীণ জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান (বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সচিব) টেলিফোন একচেঞ্জ থেকে এ  কথা জানতে পান। গাইবান্ধার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব লুৎফর রহমান ও ওলিউল রেজা ওয়ারলেস সেন্টার থেকে সেটি সংগ্রহ করে পরেরদিন সকালে মাইকে প্রচার করেন। পাবনা জেলার তৎকালীন সিরাজগঞ্জ মহকুমার সোনাইজুড়ি ইউনিয়নের পোস্ট মাস্টার আখতার হোসেন ম্যাসেজটি সংরক্ষণ করে প্রচারের উদ্যোগ নেন। কোন তথ্য বের করতে না পেরে পাকিস্তানি সৈন্যরা সুবেদার মেজর শওকত আলীর শরীরে জলন্ত সিগারেট দিয়ে পুড়িয়ে ঘাঁ করে দেয়। উপড়ে নেয় মাথার চুল, নখ, দুই চোখে ঢুকিয়ে দেয় লোহার শিক। এরপরও তার কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে না পেরে ২৯ এপ্রিল ঢাকার নারায়নগঞ্জে পাগলা নদীর ঘাটে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে অনেক কথা অনেক যাচাই পর্ব হয়েছে। কিন্তু  এর বড় সাক্ষী বঙ্গবন্ধু নিজেই । পাকিস্তানে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে আসার পাঁচ দিন পর উনিশশো বাহাত্তর সনের ১৬ জানুয়ারি নিউওর্য়াক টাইমস-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিডনিস্ক্যানবার্গকে দেয়া তার সাক্ষাৎকারে এর সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। আর এক সাক্ষী ছাত্রনেতা কাজী আরিফ, তিনি বেঁচে নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে অনেক বার যাচাই হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়, পরবর্তী সরকার এবং বর্তমান সরকারের যাচাইএ একই সত্যতা পাওয়া যায়। 

সুবেদার মেজর শওকত আলীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, তার জন্ম ১৯২৭ সালে ভারতের বীরভূমের পাইকপাড়া গ্রামে। তার রক্তে প্রবাহিত ছিল বিপ্লবী ধারা। তার পরিবার আদিবাসিদের অধিকারের প্রশ্নে ছিলেন সোচ্চার। ম্যাট্রিকুলেশনের পর তিনি বৃটিশ সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরে যোগ দেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর তিনি বেঙ্গল পুলিশের সিগন্যাল উইং এ যোগ দেন। দাঙ্গা রোধ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অবদান রেখে প্রশংসা পান। এজন্য বেঙ্গল পুলিশ কর্তৃপক্ষ ১০রুপি সম¥ানী ভাতা প্রদান করেন। ভারতবর্ষ বিভক্ত হলে তিনি কলকাতা পুলিশ হেডকোর্য়াটার ওয়ারলেস যন্ত্রপাতি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসে পুলিশ বাহিনী পূনর্গঠনে ভূমিকা রাখায় পাকিস্তান সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পুলিশ পদক প্রদান করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহীর জেলা সদরের কাজীহাটায় বাড়ি নেন। এরপর তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে (ই.পি.আর) যোগ দিয়ে এর সিগন্যাল কাঠামো গড়ে তোলেন। ১৯৬২ সালে আসালং, লাঠিটিলা, পাথারিয়া সীমান্তে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান সরকার তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠালে, সেখানেও তিনি কৃতিত্ব দেখান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের সময় বিশেষ অবদানের জন্য তমঘা-এ-জঙ্গ খেতাবে ভূষিত হন। তার কর্মস্থলে অবাঙালি অফিসার ও অন্যান্যদের সাথে সুসম্পর্ক থাকলে তিনি নিজের কথা চিন্তা না করে সবসময় তার বাঙালি সহকর্মী অন্যান্যদের বিষয়ে সোচ্চার থাকতেন। তবে তার প্রতিদ্বন্দী ছিল এক পাঞ্জাবী জেসিও। জানা যায়, সবেদার মেজর শওকত আলীর সার্ভিস বুকে লেখা হয় Service Record satisfactory. But he is suspected to keep in touch with Indian high officials through his relations in Rajshahi.   তাকে আগরতলার মামলার বিষয়ও সন্দেহ করা হতো। তার সার্ভিস বুকে সর্বশেষ লিখা আছে, He was found absconding from 29th April.

 ১৯৭০ এর নির্বাচনের পর পরিস্থিতি তাকে ভাবিয়ে তোলে, নিয়ে ফেলেন প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইপিআর হেডকোয়র্টারের আশেপাশে সেনাবাহিনীর অবস্থান তার কাছে সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। পিলখানার ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারের সিগন্যাল সেন্টার তার অবদানে আধুনিক রুপ লাভ করে। ২৪মার্চ সেখানকার চাবি তার কাছ থেকে নিয়ে নিলে এবং সেন্টারটি বন্ধ করে দিলে তিনি বুঝে ফেলেন সামনে ভয়াবহ পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রচন্ড বিশ^াস করতেন। তিনি খবর পান, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের বাঙালি সৈনিকদের ব্যারাকে থাকতে বলা হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি সৈনিকদের ব্যারাকে না থেকে ব্যারাকের ছাদে থাকতে পরামর্শ দেন। এরপরে ২৫মার্চের রাতের সেই ঘটনা। তার কোন খোঁজ না পেয়ে ১০ সেপ্টেম্বর তার স্ত্রী, কন্যা সেলিনা পারভীনকে নিয়ে পিলখানায় গেলে সিগন্যাল কোরের অবাঙালি কর্ণেল আব্দুর রহমান আওয়ান, শহিদ মেজর শওকত আলীর বই, খাতা, ডায়রি ফেরত না দিয়ে টেলিভিষন ও মোটরসাইকেল ফেরত দিয়ে বলেন,‘ তিনি কোয়ার্টার থেকে ওয়্যারলেস সহ ধরা পড়েন। তার কাছে মুজিবের ম্যাসেজ পাওয়া যায়’। মেজর এজাজ ও ক্যাপ্টেন আকতার একি মন্তব্য করেন। ২৯ এপ্রিল সুবেদার শওকত আলীকে যখন নারায়নগঞ্জের পাগলা ঘাটে হত্যা করা হয়, তখন তার এক সহকর্মী কৌশলে বেঁচে গিয়ে পরবর্তীতে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। 

সেখানে তিনি এক সঙ্গীকে ঘটনার বর্ণনা করলে তিনি বিজয় অর্জনের পর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলীর পরিবারকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলী যে দুঃসাহসিক অবদান রাখেন, তা কোন অংশে কম নয়। তাকে জাতীয় সম্মানে সম্মানিত করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম বিষটি তুলে ধরে দাবি জানায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আসে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনী ২০১৬ সালের ২০ডিসেম্বর বর্ডার গার্ড বাহিনী দিবসে জাতীয় বীর সুবেদার শওকত আলীকে জাতীয় বীরের মর্যাদায় সম্মানিত করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার মাধ্যমে সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলীর কন্যা সেলিনা পারভীনের হাতে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বাহিনীর সব্বোর্চ পদক ‘ বর্ডার গার্ড বাহিনী’ পদক তুলে দেন। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী জাতীয় একটি অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে এ বীরের অবদানের কথা তুলে ধরেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) পিলখানার হেডকোয়ার্টারে তার নামে যাদুঘর করা হয়েছে। চিত্তনির্মাতা কাউসার চৌধুরী তাকে নিয়ে একটি প্রামান্য চলচিত্র নির্মাণ করেছেন উত্তর জনপদের নানা আন্দোলনের পীঠ রাজশাহী জেলা সদরের এই সাহসী মানুষটিকে স্মরণীয় করে রাখতে সিটি কর্পোরেশন সহ সংশ্লিষ্ট মহলের উদ্যোগ প্রয়োজন। (তথ্যসূত্র: জাতীয় বীর সুবেদার মেজর শহিদ শওকত আলীর কন্যা প্রফেসর সেলিনা পারভীন ও জামাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী লুৎফর রহমান খোকন)


লেখক, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক রাজশাহী।