বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘রক্তঝরা ঊনিশ’ একাত্তরের ৭ মার্চ। বাঙালী জীবনের এক ঐতিহাসিক দিন। এদিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি ভিন্নমাত্রা পেয়েছিল। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ডাকে রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল মুক্তিপাগল বাঙালীর। মুহূর্তেই উদ্বেল হয়ে ওঠে জনতার সমুদ্র। মুহুর্মুহ স্লোগানে কেঁপে উঠে বাংলার আকাশ। নড়ে ওঠে হাতের ঝান্ডায় তাদের গর্বিত লাল-সবুজ পতাকা, পতাকার ভেতরে সোনালী রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণই যে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল তা বুঝতে বাকি রইলো না মুক্তিপাগল বাঙালী জাতিসহ পাক সামরিক জান্তাদেরও। গোটা বাঙালী জাতিই ৭ মার্চের ভাষণ বুঝে গেলেন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণেই মুক্তিপাগল বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করেছিল। একাত্তরের ঐতিহাসিক এই দিনে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলা সমন্বয় কমিটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার লগ্নে গেরিলা যুদ্ধের আহ্বান জানান।
কমিউনিস্ট পার্টির প্রচারপত্রে আহ্বান জানানো হয়,- ‘আঘাত হানো, সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করো, জনতার স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম করো।’ পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ (মুজাফফর) পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের জন্য ১৭ দফা প্রস্তাব দেয়। এতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারসহ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করা হয়।
৭ মার্চ ঢাকা ছিল লাখো মানুষের শহর। বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ ছুটে এসেছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’-স্লোগানে ঢাকা শহর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল। কখন ঘটবে বিস্ফোরণ এমন একটি পরিস্থিতি বিরাজ করে সারা শহরে। শেখ মুজিব নিজ মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা করলে তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে নির্বিচারে বাঙালী নিধনের ঘৃণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভারি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে প্রস্তুত ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। আকাশে উড়ছিল সামরিক জঙ্গী বিমান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সে সুযোগ দেননি হানাদারদের। টানটান উত্তেজনার মধ্যে রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় এই জনসভা।
বিচ্ছিন্নতাবাদীর দায় চাপিয়ে দেশের স্বাধীনতাকে যাতে পাকিস্তানী সামরিক জান্তারা বিলম্বিত করতে না পারে সেজন্য বঙ্গবন্ধু পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটি ভাষণ দেন। সরাসরি না দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন। একটি মাত্র ভাষণেই নিরস্ত্র বাঙালী জাতি সশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয়। আর বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে এ নির্দেশ পেয়েই নিরস্ত্র বাঙালী জাতি সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে। বাঙালীর দেশপ্রেমের অগ্নিশিখায় পরাস্ত করে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে মহামূল্যবান স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এ ভাষণটি স্থান করে নিয়েছে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের তালিকায়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ একুশটি বছর বঙ্গবন্ধুর বজ্রনির্ঘোষ অমিততেজী এই বক্তব্যটি বাজানোর ওপর অঘোষিত ছিল নিষেধাজ্ঞা। শুধু ভাষণই নয়, বঙ্গবন্ধুর নামটুকু পর্যন্ত ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার কতই না চেষ্টা চলে সামরিক স্বৈরাচার এবং তাদের গর্ভে জন্ম নেয়া ক্ষমতাসীন অবৈধ সরকারের সময়।
কিন্তু সত্যকে কখনও মিথ্যা দিয়ে বেশিদিন চেপে রাখা যায় না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণটি আজ বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। ইউনেস্কো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই বাঙালী জাতি, বাংলাদেশ যতদিন থাকবে- ততদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যুগে যুগে জাতিকে উজ্জীবিত, উদ্বেলিত করবে। শিহরণ জাগাবে মানুষের রক্তে, দেশের জন্য আত্মত্যাগ করার মন্ত্রে দিক্ষীত করবে।
সূত্র: জনকণ্ঠ