*সমাজকে অভিশাপমুক্ত করাই মূল লক্ষ্য
*ঢেলে সাজানো হচ্ছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর
*অধিদফতরের ক্ষমতা বাড়বে
*থাকবে অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত বাহিনী, নৌ-ইউনিট, ডগ স্কোয়াড
অনলাইন ডেস্ক: মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে যে কোন মূল্যে সমাজকে বাঁচানোই এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য। মাদক নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মূল ভূমিকায় থাকবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এজন্য আপাদমস্তক পরিবর্তন আসছে এই প্রতিষ্ঠানে। বাড়ানো হবে ক্ষমতা। থাকবে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী, নৌ ইউনিট, ডগ স্কোয়াড এবং আধুনিক ল্যাবরেটরি। ‘ঠুঠো জগন্নাথের’ বদনাম ঘুচিয়ে এই প্রতিষ্ঠানই নেতৃত্ব দেবে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে। এখন থেকে মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীরা শুধু র্যাব-পুলিশকে নয়, আমলে নিতে বাধ্য হবে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে।
মাদকের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এতদিন নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ক্ষেত্র বিশেষে কিছু কর্মকাণ্ড ছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তেমন কোন ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। সমাজ থেকে মাদক নির্মূলে এই প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য সকল মহল থেকে ছিল দীর্ঘদিনের দাবি। এর প্রেক্ষিতে মাদক বিভাগকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ জন্য পুরনো আইনে বেশ কিছু সংশোধনী ও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। খুব শীঘ্রই বদলে যাবে পুরনো আইন। নতুন করে সাজানো হচ্ছে গোটা প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিধি। মাদকসংক্রান্ত জাতীয় কমিটির পরবর্তী বৈঠকে এ ধরনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসছে। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার এ ধরনের কর্মপরিকল্পনার কথা জানিয়ে বলেন, নতুন রূপে আসবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এখন থেকে সমাজকে মাদকের অভিশাপমুক্ত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এই প্রতিষ্ঠান। আপোসহীন মনোভাবে কাজ করবে মাদক বিভাগ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, মাদক অধিদফতরকে আরও শক্তিশালী করতে প্রতিষ্ঠানের কিছু বিধিতে সংশোধন আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একটি কমিটি এ নিয়ে কাজ করছে যার প্রতিবেদন হাতে আসার পরই বাস্তবায়ন করা হবে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, সময়ের প্রয়োজনেই বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। বিশেষ করে অস্ত্র ব্যবহারের জন্য আইনগত দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেলেই এই সংস্থাকে অস্ত্র দেয়ার বিষয়ে আর কোন বাধা থাকবে না। এতে কাজের গতি যেমন বাড়বে তেমনি মাদক নিয়ন্ত্রণেও সুফল আসবে। একই সঙ্গে ডগ স্কোয়াড ও মোবাইল ফোনের লোকাল ট্রেকার সুবিধা পাওয়া গেলে বদলে যাবে মাদক নির্মূলের পুরো প্রক্রিয়া। আমরা আশাবাদী অচিরেই এ ধরনের আধুনিকায়ন শুরু করতে পারব। এগুলো আজকে সময়ের দাবি। এতে সবারই সায় রয়েছে।
মাদক বিভাগ সূত্র জানায়, বর্তমানে মাদকবিরোধী অভিযানে পুলিশের সহায়তা নিতে হয়। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের সময় চাওয়া মাত্রই পুলিশ পাওয়া যায় না। এ সুযোগে মাদককারবারিরা আস্তানা ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযানের খবর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ ছাড়া অস্ত্রধারী মাদককারবারিদের হামলায় আহত হওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। মাদক অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বিগত এক দশকে নিরস্ত্র এই বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্রধারী মাদককারবারিদের কাছ থেকে রিভলবার ১৩টি, পিস্তল ৫৭টি, শর্টগান একটি, পাইপগান একটি, এয়ারগ্যান চারটি, ম্যাগজিন ২৩টি এবং ৬৪৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছেন। অনেক সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করতে হচ্ছে। এছাড়া দিন দিনই মাদককারবারিরা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হচ্ছে, যা অভিযানের জন্য হুমকিস্বরূপ। সেজন্যই মাদক বিভাগের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এমন সব প্রতিবন্ধকতায় নিজস্ব অস্ত্রধারী সদস্য থাকলে কাজের গতি যেমন আসবে তেমনি মাদককারবারিরাও আতঙ্কে থাকবে। বাস্তবতার আলোকেই মাদক বিভাগ নিরাপদে অভিযান চালানোর স্বার্থে অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা ও যুক্তি তুলে ধরে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তারই প্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগও সাড়া দিয়ে বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ প্রদান করে। তারই ধারাবাহিকতায় জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির প্রথম সভায় অস্ত্র প্রদানসহ আরও কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। কার্যত তারপরই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এ বিষয়ে দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে।
গত ডিসেম্বরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটির প্রথম সভা হয়। তাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম, পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুল মান্নান, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাসহ সংশ্লিষ্ট সচিব ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সেদিনের সভায় সবাই এই অধিদফতরের সদস্যদের অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার পক্ষে সরাসরি মত দেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। এই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির পরবর্তী সভায় অস্ত্র প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
জানা গেছে, অস্ত্রের জন্য ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় দক্ষ ও পেশাদার জনবল তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে সরাসরি ইনফোর্সমেন্ট কাজের জন্য ১ হাজার ৮০০ জনবলের মঞ্জুরি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৭শ’ জনবল নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তাদের মধ্যে ৫শ’ সিপাহীর নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত। এদেরই অস্ত্রধারী সিপাহীর দায়িত্ব দেয়া হবে। মূলত সিপাহী, এসআই ও ইন্সপেক্টরদের অস্ত্র দেয়ার বিষয়ে প্রস্তাব করা হয়েছে। যা বিশেষ বিবেচনাধীন রয়েছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্র ও ডগ স্কোয়াডের পর সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে মোবাইল ফোনের লোকাল ট্রেকার। অনেক চেষ্টার পর ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারে (এনটিএমসি) মাদক বিভাগের জন্য একজন কর্মকর্তাকে এই কাজে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এখন তারা অপেক্ষায় রয়েছে লোকাল ট্রেকারের। এই ট্রেকার পাওয়া গেলে মাদককারবারিদের অবস্থান নির্ণয়ে আর কারোর সহায়তা নিতে হবে না।
মহাপরিচালক জানিয়েছেন, অপারেশনাল কাঠামোতে পরিবর্তনের পাশাপাশি মান্ধাত্মা আমলের আইনেরও কিছু আধুনিকায়ন দরকার। মাদক নিয়ন্ত্রণ জাতীয় বোর্ড থাকলেও ২০১৮ সালে প্রণীত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৩(ক) নম্বর ধারায় জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়েছে। অধিদফতরকে শক্তিশালী ও গতিশীল করতে কিছু কার্যক্রম চলমান। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত নিরস্ত্র কর্মী বাহিনী মাদক উদ্ধারের পাশাপাশি অনেক আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক কর্মীকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তাই অস্ত্র, ডগ স্কোয়াড, মোবাইলের লোকাল ট্রেকার ও নৌইউনিট দ্রুত বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করছি। যত তাড়াতাড়ি এগুলো দেয়া হবে তত দ্রুতই মুক্তি মিলবে এই অভিশাপ থেকে।
সূত্র: জনকণ্ঠ