*বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে
*৬ মাসে ব্যাংক খাত থেকে সরকার নিট ঋণ নিয়েছে মাত্র ৫৯৫ কোটি টাকা
*বেসরকারী খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের
অনলাইন ডেস্ক: প্রণোদনার অর্থ বিতরণের পরও বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে কাক্সিক্ষত মাত্রার প্রায় অর্ধেকে। ৬ মাসে ব্যাংক খাত থেকে ঘোষণা অনুযায়ী মাত্র ৫৯৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। এ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে তৈরি হয়েছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ অলস তারল্যের স্তূপ। গত ডিসেম্বরের শেষে দেশের ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এই অবস্থায় বেসরকারী খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি সিএসএমই খাতের ঋণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
নোভেল করোনাভাইরাসসহ বৈশ্বিক নানা সঙ্কটের কারণে গত কয়েক বছরে বেসরকারী খাত সঙ্কুুচিত হয়েছে। কর্মসংস্থানও হারিয়েছেন অনেকেই। এখন সরকারও ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিপরীতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ ও রেমিটেন্সের উচ্চপ্রবৃদ্ধির কারণে ব্যাংকগুলোয় অলস অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু এক বছর আগে তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছিল দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারী ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। আর এখন এর ঠিক উল্টো চিত্র ব্যাংকগুলোতে। বেশির ভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার কমিয়ে ৪ শতাংশের নিচে নামিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ছিল বেসরকারী ব্যাংকগুলোর। সরকারী খাতের ব্যাংকগুলোর কাছে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৮৩ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। আর ২২ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য জমা হয় বিদেশী ব্যাংকগুলোর হাতে। চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ আরও বেড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন ঋণ নেয়ার মতো পরিস্থিতিতে তারা এখনও আসেননি। ফলে বিনিয়োগ না হওয়ায় পুঞ্জীভূত এই অর্থ ব্যাংকগুলোকে ভোগান্তিতে ফেলেছে। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘বিনিয়োগ না করে শুধু ব্যাংকে টাকা জমা করে লাভ নেই। আগে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দেয়ার মতো সুযোগ দিতে হবে।’
চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য ব্যাংক খাত থেকে ৮৪ হাজার ৯৮০ কোট টাকা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর ’২০) দেখা যাচ্ছে, সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছে মাত্র ৫৯৫ কোটি টাকা। যদিও ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৪৪ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারী বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদী ট্রেজারি বিলের ইল্ডরেট ছিল মাত্র ৪৫ পয়সা। যদিও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদী বিলের ইল্ডরেট ৬ শতাংশের বেশি ছিল। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহারে পতন হয়েছে বন্ডে। ২ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। অন্যদিকে চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহারও নেমেছে ১ শতাংশে। এ অবস্থায় সরকারী-বেসরকারী বেশির ভাগ ব্যাংকেরই ট্রেজারি ব্যবস্থাপনায় স্থবিরতা নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকার স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ নিয়ে ব্যয় নির্বাহ করছে। এ কারণে ব্যাংক থেকে অর্থের জোগান দেয়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটি সরকারের দিক থেকে ভাল। তবে বেসরকারী খাতে ব্যাংকের বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। এজন্য বড় ধরনের বিনিয়োগে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দরকার। ব্যাংক ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় ও মাঝারিদের সমস্যা না হলেও কুটির, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক এ গবর্নর। ড. ফরাসউদ্দিনের ভাষ্য, ঋণের পাশাপাশি সরকার ঘোষিত প্রণোদনার অর্থপ্রাপ্তি থেকেও ছোটরা বঞ্চিত হচ্ছে। এ অবস্থায় সিএসএমই খাতের ঋণের জন্য কাঠামোগত সংস্কার দরকার। এসএমইদের ঋণ দিতে পিকেএসএফ, এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিককে কাজে লাগাতে হবে।
ব্যাংক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত তারল্যের চাপে এখন চ্যাপ্টা হওয়ার অবস্থায় পড়েছে। এতদিন অতিরিক্ত তারল্যের অর্থ বিনিয়োগ করত সরকারী বিল-বন্ড বা কলমানি বাজারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে ট্রেজারি বিলের সুদহার নেমে এসেছে ১ শতাংশের নিচে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯১ দিন মেয়াদী ট্রেজারি বিলের ইল্ডরেট ছিল মাত্র ৪৫ পয়সা। যদিও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদী বিলের ইল্ডরেট ৬ শতাংশের বেশি ছিল। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেও। ২ বছর মেয়াদী ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। আর চাহিদা না থাকায় কলমানি বাজারের সুদহার নেমেছে ১ শতাংশে।
দি সিটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘অতিরিক্ত তারল্য ব্যাংক খাতকে এখন কষ্ট দিচ্ছে। যেভাবে আমানত আসছে, ঠিক সেই তুলনায় নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।’ তার মতে, নতুন বিনিয়োগের জন্য আমাদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও দেশে এ মুহূর্তে বড় কোনও শিল্প উদ্যোগ নেই বললেই চলে। ভাল ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চাইছেন না বলেও জানান তিনি। এমন পরিস্থিতির কারণেই দেশের ব্যাংক খাতে অলস তারল্যের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এক বছর আগেও তীব্র তারল্য সঙ্কটে ভুগছিল বেশিরভাগ ব্যাংক। নগদ জমা সংরক্ষণের হার (সিআরআর) ও সহজে বিনিময়যোগ্য সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণেই হিমশিম খাচ্ছিল বেসরকারী ব্যাংকগুলো। তারল্যের সংস্থান করতে বেশি সুদে অন্য ব্যাংকের আমানত বাগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।
প্রসঙ্গত, বিদায়ী অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে তারল্যের জোগান দিয়েছে ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭৯ কোটি টাকা। রেপো, স্পেশাল রেপো ও এ্যাসুরেড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) হিসেবে এ অর্থ দেয়া হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা হিসেবেও প্রায় এক লাখ কোটি টাকার অর্থ জোগান দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জোগান দেয়া এই অর্থও অতিরিক্ত তারল্য সৃষ্টির পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সূত্র: জনকণ্ঠ