*ঢাবি শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে এসএমএস
অনলাইন ডেস্ক: হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হিযবুত তাহ্রীর। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটি রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং করেছে। খিলাফত রাষ্ট্র ধ্বংসের একশ’ বছর শিরোনামের এই পোস্টারে বিশ্বের একশ’ শহর থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রতি খিলাফত প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে মোবাইলে পাঠানো হয়েছে এসএমএস। এর বাইরেও ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খুলে প্রচার চালাচ্ছে সংগঠনটি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, খিলাফতের ডাক দেয়া পোস্টার দেশের মানুষকে যতটা না প্রভাবিত করবে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে শিক্ষার্থীদের পাঠানো দাওয়াতি মেসেজ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ফাঁদে পা দিতে পারে এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, তারা এসব কার্যক্রম নজরদারির মধ্যেই রেখেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও চলমান রয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর সেগুনবাগিচা, সায়েন্স ল্যাব, ধানমণ্ডি, জিগাতলা, শঙ্কর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, লালবাগ, আজিমপুর, শাহবাগ, কাঁটাবন এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে হিযবুত তাহ্রীরের এসব পোস্টার দেখা যায়। অনেককেই পোস্টার পড়তে দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এটি কোন জঙ্গী সংগঠনের কাজ। কেউ বলছেন, দেশের মানুষকে এত সহজে কেউ ভুল পথে পরিচালিত করতে পারবে না। সচেতন নাগরিকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন কিভাবে এত পোস্টার দিয়ে ছেয়ে দিয়েছে রাজধানীকে!
জানা গেছে, রাতে সড়কগুলো যখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই কে বা কারা এসব পোস্টার লাগিয়েছে। এমনকি রমনা থানার বিপরীত পাশের দেয়ালেও দেখা গেছে এই পোস্টার।
পোস্টার লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানার একজন পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাতের বেলা সচরাচর স্কুল-কলেজে ভর্তি, কোচিং সেন্টার ও ওয়াজ মাহফিলের পোস্টার লাগানো হয়ে থাকে। গত ৯ মার্চ রাতে সুযোগ বুঝে কে বা কারা হিযবুত তাহ্রীরের পোস্টার লাগিয়েছে। তাদের পরিচয় জানা যায়নি। তবে এখন থেকে আমরা সজাগ রয়েছি।
কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, এর আগে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সিলেট মহানগরীতেও হিযবুত তাহ্রীরের এসব পোস্টার দেখা গেছে। ওই পোস্টারগুলোতেও খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়া হয়। এমন সময়ে রাজধানী ঢাকায় হিযবুত তাহ্রীরের এসব পোস্টার লাগানো হয়েছে, যখন সাড়ম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। একইসঙ্গে চলছে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান। এসব আয়োজনে বিদেশী রাষ্ট্রনেতারাও বাংলাদেশ সফরে আসছেন।
কেবল পোস্টারিং নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে হিযবুত তাহ্রীর। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি খিলাফতের আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে একটি পেজ খোলা হয়েছে। একদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি একই নামে খোলা হয়েছে একটি ইউটিউব চ্যানেল। এর মধ্যে ইউটিউব চ্যানেলটিতে পাঁচটি ভিডিও দেখা গেছে। চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার মাত্র ১৩ জন হলেও পাঁচটি ভিডিওর মধ্যে একটি ভিডিওর ভিউ (দর্শক) ছিল সাত হাজার তিনশ’।
অন্যদিকে, ফেসবুক পেজটিতে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছেন ৭৪৬ জন অনুসারী। পেজটিতে রয়েছে শতাধিক পোস্ট, যার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ভিডিও। এসব পোস্টে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেয়ার পাশাপাশি চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনাও করা হয়েছে। আর এই ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের লিংকগুলোই এসএমএস করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের।
হিযবুত তাহ্রীরের পাঠানো মেসেজ পেয়েছেন- এমন তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাদের অন্তত ১০ জনের মোবাইল ফোনে আসা এসএমএসের স্ক্রিনশট সংরক্ষিত রয়েছে। এসব শিক্ষার্থী এই বার্তাকে ‘উগ্রবাদী’ তৎপরতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা বলছেন, একটি নিষিদ্ধ সংগঠন যেভাবে প্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সক্রিয় তৎপরতা প্রয়োজন। খিলাফতের নাম করে পাঠানো এসব বার্তায় কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হতেই পারে- এমন ধারণাকেও উড়িয়ে দিতে পারছেন না তারা।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, কোভিড-১৯-এর কারণে জঙ্গী সংগঠনগুলো অনলাইনে প্রচার বাড়িয়েছে। কেউ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। সবাই ঘরের মধ্যে সময় পার করছে। আমার ধারণা, এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে হিযবুত তাহ্রীর। এজন্য তারা মেসেজ দিয়ে দাওয়াত দিচ্ছে। আবার তারা সুযোগ বুঝে পোস্টারিংও করেছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হওয়ার তাগাদা দিয়েছেন তারা। বলছেন, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় হতে হবে। এদের সোর্সিংটা খুঁজে বের করতে হবে। কারা পোস্টারিং করছে, চেষ্টা করলে তাদের হয়তো ধরাও সম্ভব।
পুলিশের বেশ কয়েক কর্মকর্তা জানান, হিযবুত তাহ্রীরের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চলছে। এসএমএস পাঠানো বা পোস্টারিংয়ের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতেও কাজ চলছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে জঙ্গী তৎপরতা ও উগ্র ইসলামী সংগঠন হিসেবে এরই মধ্যে আট জঙ্গী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহ্রীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে নিষিদ্ধ হলেও হিযবুত তাহ্রীরের তৎপরতা বন্ধ ছিল- এমনটি বলা যায় না। কেননা, নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মাঝে মাঝেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিযবুত তাহ্রীরের সদস্যরা গ্রেফতার হয়েছেন। সবশেষ অতি সম্প্রতি রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা থেকে এই সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া ২০১৮ সালের ২৬ নবেম্বর রাজধানীতে মিছিল করতে দেখা যায় হিয্বুত তাহরীরকে। ২০১৯ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগেও হিযবুত তাহ্রীরের বেশকিছু পোস্টার দেখা যায় ঢাবি এলাকায়। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলছেন, হিযবুত তাহ্রীর একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। তাদের ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে। এদের অনেককেই ধরা হয়েছে। কিন্তু এরা অহিংস (নন-ভায়োলেন্ট) হওয়ায় আদালত থেকে জামিন পেয়েছে। এরকম অনেকেই জামিন পেয়ে পরে আবারও একই ধরনের কাজ করেছে। কিছুদিন আগেও সূত্রাপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
তিনি আরও বলেন, তাদের ওপর আগেও নজরদারি ছিল, এখনও আছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও এ্যাকাউন্ট ডাউন (বন্ধ) করা হয়েছে। ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। যেহেতু তারা নিষিদ্ধ সংগঠন, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। হিযবুত তাহ্রীরের সবশেষ এসব তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদেশে থেকেও অনেকে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রমে জড়িত আছে। পোস্টারিংয়ের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা তাদের ধরতে কাজ করছি। আর কোন সংরক্ষিত ডাটাবেজ থেকে নম্বর নিয়েই তারা শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠাচ্ছে। এই বিষয়টিও আমরা দেখছি। তারা আমাদের নজরদারির মধ্যেই আছে।
সূত্র: জনকণ্ঠ