*মন্ত্রিসভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ
অনলাইন ডেস্ক: জনকণ্ঠের সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেছে মন্ত্রিসভা। সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকের শুরুতে শোক প্রস্তাবটি উপস্থাপন করেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী এই শোক প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আতিকউল্লাহ খান মাসুদ দেশের জন্য অনবদ্য অবদান রেখে গেছেন। তাঁর এই অবদান ভোলার নয়। তার এই অবদান জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে চরম নির্যাতনের শিকার হয়েও দৈনিক জনকণ্ঠ এবং এর সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিকউল্লাহ খান মাসুদ কখনও নীতির প্রশ্নে আপোস করেননি, বরং অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। ওই দুঃসময়ে দৈনিক জনকণ্ঠের সাহসী ভূমিকার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের চরম দুঃশাসনের সময় একটিমাত্র পত্রিকা দৈনিক জনকণ্ঠ এবং এর সম্পাদক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ দায়িত্ব নিয়ে সত্য সংবাদ পরিবেশ করেছে। তার জন্য জনকণ্ঠ সম্পাদককে খেসারতও দিতে হয়েছে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই তাঁর ওপর অমানুষিক অত্যাচার, এমনকি তাঁর বাড়িটাও বুলডোজার দিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে। তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য সমস্ত ধ্বংস করে দিয়েছিল। আতিকউল্লাহ খান মাসুদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন বলেই নির্যাতনের মুখেও নীতির প্রশ্নে কখনও আপোস করেননি, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে সাংবাদিক জগতে একজন সাহসী ও ভাল লোককে আমরা হারালাম।
অত্যন্ত সাহসী আতিকউল্লাহ খান মাসুদ যুব বয়সেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে ২ নং সেক্টরের অধীনস্থ মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানা কমান্ডার হিসেবে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেন এবং বড় বড় অপারেশনে অংশ নেন। বিশিষ্ট এই মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে ১৯৭২ সালে সফলভাবে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে কর্মজীবন শুরু করেন। তৎকালীন সফল তরুণ শিল্পপতিদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তিনি বিভিন্ন শিল্প-কারখানা গড়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন।
১৯৭৮ সালে তিনি সাফল্যের সঙ্গে জাপানের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব ইনসেক্টিসাইডস লিঃ নামে দেশের প্রথম মশার কয়েল প্রস্তুতকারী শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ধোঁয়াবিহীন মশা নিবারক গ্লোব ম্যাট ও তেলাপোকা ধ্বংসকারক গ্লোব এ্যারোসল এই দুটি পণ্য ওই কারখানায় উৎপাদন শুরু করা হয়। ১৯৯০ সালে গণচীনের কারিগরি সহযোগিতায় গ্লোব মেটাল কমপ্লেক্স লিঃ নামে আরও একটি ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৯৩ সালে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং সফল শিল্পপতি হিসেবে তার জীবনের সবচেয়ে সফল সংযোজন দেশের অন্যতম এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকা ‘দৈনিক জনকণ্ঠ’ প্রকাশ করেন। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক হিসেবে তিনি এই জাতীয় দৈনিকটি সর্বপ্রথম অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয়ে দেশের ৪টি স্থান থেকে একই সঙ্গে প্রকাশ করে দেশের সংবাদপত্র শিল্পে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতায় খুব দ্রুতই জনকণ্ঠ দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনায় পরিণত হয়। প্রকাশের তিন বছরের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য পত্রিকা হিসেবে দেশের শীর্ষস্থান দখল করতে সক্ষম হয়। পত্রিকাটি প্রকাশ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ এবং প্রচার করে আসছে। পাশাপাশি পত্রিকাটি সব সময় স্বাধীনতা বিরোধীদের বিপক্ষে সরব অবস্থানে রয়েছে। তার অন্যতম প্রকাশনা হচ্ছে ‘সেই রাজাকার’। এই বইটি দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
আতিকউল্লাহ খান মাসুদ ১৯৯৭ সালে ডেইরি ও কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য গ্লোব খামার প্রকল্প নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। ১৯৯৮ সালে দেশের গৃহায়ন সমস্যা বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত নাগরিকদের জন্য গৃহায়ন সমস্যা সমাধানকল্পে গ্লোব কনস্ট্রাকশন লিঃ নামে আরও একটি গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।
২০০০ সালে তার সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য সমন্বয়কারী হিসেবে গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি নিজস্ব সাংগঠনিক মেধা ও প্রশাসনিক দক্ষতার গুণে প্রতিবছর দেশের কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে দেশে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন এবং দেশে তার প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহে অদ্যাবধি কয়েক হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। বর্তমানে ‘গ্লোব জনকণ্ঠ শিল্প পরিবার লিমিটেড’ অবস্থানগতভাবে বাংলাদেশে সফল, সুপরিচিত ও বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃত।
জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সপক্ষে এবং নীতির প্রশ্নে আপোসহীন দৈনিক জনকণ্ঠ যে সাহসী ভূমিকা পালন করে আসছে তা সহ্য করতে না পেরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী সেই চক্র ওয়ান/ইলেভেনের শুরুতেই অর্থাৎ ২০০৭ সালের ৭ মার্চ মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে জনকণ্ঠ ভবন থেকে রাত ১০টায় গ্রেফতার করে ৪২টি মিথ্যা মামলা দিয়ে ৪৫ কোটি টাকা জরিমানা এবং ৪৮ বছর কারাদন্ড প্রদান করে দীর্ঘ ২২ মাস ১২ দিন কারান্তরীণ রাখে। গণতন্ত্র ফিরে এলে ২০০৯ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
এ সময় আতিকউল্লাহ খান মাসুদ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত হন। ১৯৮৪-৮৬ তিন সালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবের সহসভাপতি ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে গরিব ও অনাথ শিশুদের বিনা খরচে চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বিক্রমপুরের লৌহজং মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন।
সূত্র: জনকণ্ঠ