ঢাকাশুক্রবার , ৫ মে ২০২৩
  • অন্যান্য

30 March 1971 North Bengal Sugar Mills

অবাঙালিদের মাথায় সাদা রুমাল॥ গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে হত্যাযজ্ঞ

Paris
  • ওয়ালিউর রহমান বাবু

    মে ৫, ২০২৩, ১:১১ অপরাহ্ণ
নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে গণহত্যা দিবস। স্মৃতিস্তম্ভ

১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ পাকিস্তানী সৈন্যরা তৎকালীন নাটোর মহকুমার লালপুর থানার গোলাপুর ময়নায় স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের কাছে প্রতিরোধের সম্মুক্ষীন হয়। ময়নায় ধরা পড়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেজর রাজা আসলাম ও সুবেদার গুল বাহার কে গোপালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে আনা হলে, সংগঠকদের বাধা উপেক্ষা করে স্বাধীনতাকামী জনতা তাদের কে জোর করে লালপুরে নিয়ে গেলে ময়নায় নির্যাতন হত্যাযজ্ঞ চালানোর অপরাধে জনতার রায়ে তাদের শাস্তি দেয়া হয়। তারা নিহত হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈন্যরা গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিলের কর্তৃপক্ষ ও কর্মচারীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শ্রমিক নেতা স্বপন কুমার পালের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, পাকিস্তানী সৈন্যরা ৫মে গোপালপুর নর্থবেঙ্গল সুগার মিলে হত্যযজ্ঞা চালাতে আসার সময় শিমুলতলায় কয়েকজন টমটম যাত্রীকে হত্য করে।

গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের ছেলে সংস্কৃতিক অনুরাগী আনোয়ার হোসেন ও তার ভাই আতাউর তাদের হাত থেকে রক্ষা পাইনি। পাকিস্তানী সৈন্যরা মসজিদের সামনে বাজারে ডাক্তার শাহদৎ আলী, আশরাফ আলী, চা বিক্রেতা সারদার রহমান, স্টেশনারী দোকানী তোফাজ্জল হোসেন, মুদি দোকানি আবুল হোসেন কে হত্যা করে। পাকিস্তানী সৈন্যদের গুলিতে আহত নির্যাতিত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া মিলের কর্মচারী খন্দকার জালাল আহমেদ ও জলিল সিকদারের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ময়নার ঘটনার জের ধরে মিলটির অবাঙালিদের মদদে পাকিস্তানী সৈন্যরা মিলটিতে হত্যযজ্ঞ চালায়। মিলটির অফিসার কর্মচারীরা যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তখন পাাকিস্তানী সৈন্যরা মিলের ভিতরে ঢুকে সকলের দিকে অস্ত্র ধরে বলে ‘মিটিং হোগা মিটিংমে চালো’।

অবাঙালিরা কর্মচারীরা মাথায় সাদা রুমাল বেঁধে বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীদের চিনিয়ে দিতে থাকে। পাকিস্তানী সৈন্যরা মিলটির জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ারুল আজিম সহ অন্যদের জোর করে ধরে এনে এক এক করে মাটিতে বসায়। পাকিস্তান সেনাবিহিনীর এক অফিসার মিলের জেনারেল ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট আজিম কে বলে ‘কিসলিয়ে তোম মেজর আসলাম কো মারা’? তিনি উত্তর দেন ‘আমরা জানি না’। পাকিস্তানী সৈন্যরা সকলকে বলে ‘তোম লোগ লেট যাও’ সকলে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে। সহকারী হিসাব রক্ষক আব্দুল মান্নানকে কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখে পাকিস্তানী সৈন্যরা তামাসা করে বলতে থাকে ‘সালে কোরআন ভী পড়নে জানতা? তোম ভি লেট যাও’ তিনিও শুয়ে পরলেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা এলোপাথাড়ি মারতে মারতে বলতে থাকে ‘তোমলোগ মেজর আসলাম কো মারা’। জেনারেল ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিম আবারো বললেন ‘আমরা কিছু জানিনা’। পাকিস্তানী সৈন্যরা সকলকে উঠে দাঁড়াতে বলে মিলের অবাঙালি কর্মচারী ইদুয়ার সাথে কি যেন বলার পরপরই সকলকে ঘিরে মিলের মধ্যে গোপাল পুকুরের ধারে নিয়ে গিয়ে গুলি ছুঁড়তে থাকে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে কারো মাথা কারো শরীর। যাঁরা বাঁচার জন্য পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিলেন পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদেরকেও গুলি করলো। বেঁচে যাওয়া গুলিবিদ্ধদের বাঁশের লাটি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করলো। গোপালপুকুর শহিদদের রক্তে লাল হয়ে গেলো। আহত হয়ে ভাগ্যক্রমে কয়েক জন বেঁচে গেলেন।

পাকিস্তানী সৈন্যরা স্বাধীনতাকামী প্রতিরোধ যোদ্ধদের খুঁজতে জেনারেল ম্যানেজার লেফটেন্যান্ট আনোয়ারুল আজিমের বাড়িতে আক্রমণের সময় বাড়ির পরিছন্ন কর্মী ভিখুর স্ত্রী শান্তি রাণী আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রী নুর নাহারকে তাদের মত করে পোশাক পড়িয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করলেন। অনেকে ভারসমহীন কেউ বা পঙ্গু অনেকে চির বিদায় নিয়েছেন। সেদিনের সেই ঘটনা এখনও অনেককে শিউরে তোলে। গোপালপুর রেলওয়ে স্টেশনের নাম করণ করা হয়েছে শহিদ আজিম নগর রেলওয়ে স্টেশন, গোপালপুকুর শহিদ সাগর। যারা শহিদ হয়েছেন পঙ্গু হয়েছেন নির্যাতিত হয়েছেন তাদের কথা কইজনই বা মনে রেখেছেন? ঝুঁকির মধ্যে অবদান রাখা শান্তি রাণীর কথা কইজনই জানে। শ্রমিক নেতা স্বপন কুমার পাল বলেছেন এই মিলে এবং এই অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা বহুজনকে হত্যা করেছে নির্যাতন করেছে। তাই শুধু একজনের নামে রেলওয়ে স্টেশনের নাম করণ করা ঠিক হয়নি। তিনি বলেছেন শহিদ পরিবার নির্যাতিত পরিবার মুক্তিযুদ্ধে অবদান ব্যাক্তিত্ব বর্গ এবং এলাকাবাসী দাবী সকল শহিদ এবং নির্যাতিতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করা হোক। দিনটি স্মরণে মিল কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে বিশেষ আয়োজন করা হয়েছে।


লেখক মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী।