নিত্যপণ্য বাজারের অস্থিরতা কমাতে শীঘ্রই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিতে যাচ্ছে সরকার। এতে করে পেঁয়াজের দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমদানির অনুমতি দেওয়ার যুক্তি তুলে ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়কে। অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয় বর্তমান বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। কোরবানি সামনে রেখে শীঘ্রই পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি প্রদানের আভাস দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক। তবে বাজারে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন এই দুই মন্ত্রী।
গত একমাস ধরে ঢাকাসহ সারাদেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এক মাসের ব্যবধানে তিনগুণ দাম বেড়ে বাজারভেদে প্রতিকেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে আমদানি বন্ধ থাকার সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। কৃষকদের কাছ থেকে কমদামে কিনে সেই পেঁয়াজ এখন উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে পাইকার, আড়তদার ও মোকাম মালিকরা। এ কারণে খুচরা বাজারে লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে এই পণ্যটির দাম। আর এক মাস পর কোরবানির ঈদ। সেই সময় পেঁয়াজের বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুদ বাড়িয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করছে। পুরো বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও অধিদপ্তরের নজরে আসায় পেঁয়াজ আমদানির পথে এগোচ্ছে সরকার। এতে করে দাম কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে, দাম কমাতে এ মুহূর্তে আমদানির বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি জানান, আমদানির পরই বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। অন্যদিকে রবিবার সচিবালয়ে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, আরও দুই থেকে তিনদিন বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, বর্তমানে ৮০ টাকার বেশি দামে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। এটা হতে পারে না। দাম বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মধ্যম আয় এবং সীমিত আয়ের সব মানুষের কষ্ট হচ্ছে। তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আমরা শেষ পর্যন্ত চাষির স্বার্থটা দেখতে চাচ্ছি। কৃষিমন্ত্রী বলেন, আমরা উচ্চপর্যায়ে, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আলোচনা করেছি।
আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে আপনারা সিদ্ধান্ত পাবেন যে আমরা বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করব কিনা। কৃষিমন্ত্রী জানান, কৃষকদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া হচ্ছে। অধিকাংশ কৃষক বলেছেন, বিক্রি করার পরও তাদের কাছে বেশ পেঁয়াজ আছে। তবে দাম বৃদ্ধি হওয়ার আশায় তারা ধরে রেখেছেন। আমরা বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ে কথা বলেছি। শীঘ্রই সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তবে শনিবার পেঁয়াজের দাম মণে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা করে কমেছে। যেহেতু কমার লক্ষণ দেখা দিয়েছে আমরা আরও দুয়েক দিন দেখব। সরকার পেঁয়াজের ‘সিন্ডিকেটকে’ নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ভেতরে ভেতরে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পেঁয়াজের উৎপাদন কম হয়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে পেঁয়াজ। এ কারণে এখন ভারত থেকে আমদানি শুরু হলে দেশে ৩০-৩৫ টাকার মধ্যে পেঁয়াজের দাম নেমে আসবে। এতে করে ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন। তবে পেঁয়াজের দাম বাড়ার এই সুফল বেশিরভাগ কৃষক বা উৎপাদনকারীরা পাচ্ছেন না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। কারণ ইতোমধ্যে কৃষকদের কাছ থেকে কমদামে পেঁয়াজ কিনে নিয়েছে পাইকার, আড়তদার ও মোকাম মালিকরা। ফলে কৃষকের কাছে এখন আর বেশি পেঁয়াজ নেই।
এ অবস্থায় কৃষকের স্বার্থ রক্ষায় আমদানি বন্ধ রেখে দাম বাড়ানো হলে এর প্রকৃত মুনাফাটা তুলে নেবে অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তাদের কষ্ট বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এই বাস্তবতায় পেঁয়াজ আমদানির পক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া ভোক্তা অধিকার নিয়ে যেসব সংগঠন কাজ করছে তারাও মনে করেন দ্রুত পেঁয়াজ আমদানির সুযোগ দেওয়া হোক। অন্যথায় কোরববানি ঈদ সামনে রেখে দেশে পেঁয়াজের বাজারে চরম সংকট তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। পেঁয়াজ এমন একটি নিত্যপণ্য যেটি প্রতিদিনের তরকারিতে ব্যবহার করা হয়। এটি ছাড়া একদিনও চলে না ভোক্তাদের। এ কারণে পেঁয়াজের পর্যাপ্ত সরবরাহ ও সঠিক দাম নির্ধারণ হওয়া উচিত।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দেশে এ মুহূর্তে ৪৫ টাকার বেশি পেঁয়াজের দাম হওয়া উচিত নয়। অথচ জাত ও মানভেদে ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি পেঁয়াজ। এদিকে, বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি করার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। রবিবার ঢাকার একটি অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন পর্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু বেশি মুনাফা লাভের আশায় অনেকে পেঁয়াজ মজুদ রেখে সংকট তৈরি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করছে। ভোক্তা পর্যায়ে পেঁয়াজের দাম কয়েক দিনের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমান বাজার বিবেচনায় আমরা পেঁয়াজ আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি। আমদানি অনুমতিপত্র (ইমপোর্ট পারমিট) বা আইপি যেহেতু কৃষি মন্ত্রণালয় দিয়ে থাকে তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে তারা এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমাদের জানিয়েছেন।
এদিকে, দ্রুত দাম কমাতে আমদানি অনুমতি (আইপি) দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। উল্লেখ্য, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যানুযায়ী প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য ১ মাস আগে ৩০ টাকা ছিল। যা গত সপ্তাহে ৫০ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে ৭৫-৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজের সরবরাহ বৃদ্ধি করে স্থিতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ অবস্থায়, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করার স্বার্থে জরুরি ভিত্তিতে সীমিত পরিসরে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে এই চিঠিতে।
এদিকে, পেঁয়াজের উৎপাদন, চাহিদা ও আমদানির তথ্য তুলে ধরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গত সপ্তাহে জানায়, গত দুই বছরে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বেড়েছে ১০ লাখ টনের বেশি। এ বছর দেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ৩৪ লাখ টনের বেশি। আর বর্তমানে মজুদ আছে ১৮ লাখ ৩০ হাজার টন। কিন্তু উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে বা প্রতিকূল পরিবেশের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৮ লাখ টন। অধিদপ্তর থেকে আরও জানানো হয়, বর্তমানে ১ কেজি দেশী পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। এই পেঁয়াজ ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হলে কৃষকরা ভালো মুনাফা করতে পারেন।
সূত্র: জনকণ্ঠ