ঢাকাসোমবার , ২২ মে ২০২৩
  • অন্যান্য

6 challenges in the new budget

নতুন অর্থবছরের বাজেট॥ সরকারের ৬ চ্যালেঞ্জ

Paris
  • অনলাইন ডেস্ক

    মে ২২, ২০২৩, ১১:১৬ অপরাহ্ণ
নতুন অর্থবছরের বাজেট সরকারের ৬ চ্যালেঞ্জ

স্বস্তিতে নেই সওদা করতে থলে হাতে বাজারে যাওয়া ক্রেতা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এ জন্য খাদ্যতালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির শঙ্কায় মধ্যবিত্ত পরিবার। সরকারও আসন্ন বাজেট বাস্তবায়নে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করছে এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এ ছাড়া বাজেট ঘোষণার আগে আরও গোটাপাঁচেক চ্যালেঞ্জ দেখছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে রয়েছেÑ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, সুদ ও ভর্তুকি ব্যয়ের টাকার সংস্থান এবং কর ও ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃজনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্ন কারণে এ বছরের বাজেট কিছুটা চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠবে। একদিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্তগুলো বাস্তবায়নেরও চাপ যেমন থাকবে, অন্যদিকে সরকারকে জাতীয় নির্বাচনের কথা বিবেচনায় রেখে জনতুষ্টির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ফলে এর সঙ্গে ভারসাম্য রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রাজস্ব আদায়ের ওপর সরকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০ এবং ২০২১ সালে পর পর দুই বছর অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছিল, সেটা ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশেও বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। এর ফলে দেশে ডলার সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। চলতি বছরেও সে অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে মূল্যস্ফীতির এ হারকে ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতিজনিত মানুষের যে টানাপোড়েন, তা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকতে পারে।

কারণ, আমদানিনির্ভর পণ্যের উচ্চমূল্য, ডলারের বাড়তি দাম এবং শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। এ সব সমস্যা যতদিন থাকবে, ততদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতিজনিত চাপে থাকবেন দেশের মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও এখনো আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। ফলে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ মোকাবিলা করতেই হচ্ছে। এতে অনেককে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে।’ বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কী করা হচ্ছে, বাজেটে সেটার পরিষ্কার ধারণা তৈরি করতে হবে।

বিশ্বের বাজারে অনেক কিছুর দাম কমে আসলেও তার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে না। এসব সংকট কিভাবে সামলানো হবে, তার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে থাকা দরকার। না হলে জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ মূল্যস্ফীতির চাপে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যাবে। তবে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের এক অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেছেন, সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। বর্তমান মূল্যস্ফীতি বৈশ্বিক কারণে সৃষ্ট। সুদের হার বাড়িয়ে এর নিয়ন্ত্রণ হবে না। সরবরাহ বাড়াতে হবে। আগামী বাজেটের মূল্যস্ফীতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাজেট হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার। সেই সঙ্গে করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যাওয়াই বাজেটের মূল লক্ষ্য।
এদিকে নতুন বাজেটেও সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে মূল্যস্ফীতিকে। কারণ, আগামী দিনগুলোতেও মূল্যস্ফীতি বহাল থাকবেÑ এমনটি ধরে নেওয়া হয়েছে। সেই হিসেবে আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা করতে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ও সুদ খাতে ব্যয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এ ব্যয়ের অর্থ সংস্থান করাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অর্থ বিভাগ। ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা এবং ভর্তুকিতে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

যদিও আইএমএফের শর্তে ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়লেও সেটি বকেয়া পরিশোধেই বেশি ব্যয় হবে। আর ভর্তুকি কমাতে আগামী ১ সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন মাস অন্তর জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় অব্যাহত থাকবে। সমন্বয় করা হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যও। এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের ভাতা ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। নতুন করে ২৪ লাখ সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ খাতে বরাদ্দ থাকছে এক লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, রিজার্ভ বাড়ানো নিয়ে চ্যালেঞ্জ আছে। রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য রেমিটেন্সে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনে যদি এ সব সূচক ঠিক না হয়, তাহলে অর্থনীতিতে আরও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডলারের এই সংকট কাটাতে রপ্তানি ও রেমিটেন্স আয় বাড়াতে জোর দেওয়া হবে। কারণ, ডলারের একটি বড় জোগান আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে। কিন্তু রেমিটেন্স থেকে আয় কমছে। এ জন্য রেমিটেন্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো একটি অ্যাপ খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য প্রবাসীদের যাত্রার শুরুতে একটি কার্ড দেওয়া হবে। ওই কার্ড ব্যবহার করে যাতে তাৎক্ষণিক অ্যাপের মাধ্যমে একজন প্রবাসী তার পরিবারের কাছে রেমিটেন্সের অর্থ পাঠাতে পারেন।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয়ের আকার ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন প্রকল্প এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তবে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় যাবে ৭৭ হাজার কোটি, পণ্য ও সেবায় ৪০ হাজার কোটি, ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি, ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ ২ লাখ ৫ হাজার কোটি এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় ৭২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে সম্ভাব্য ঘাটতির (অনুদান ছাড়া) অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ।

অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক খাত থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উৎস থেকে (এনবিআর কর) ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, নন-এনবিআর কর ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হলেও সেখানে এখনো ৩০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়েছে। আইএমএফের শর্তে জিডিপির অতিরিক্ত দশমিক ৫ শতাংশ রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বরাবরই বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, কখনোই সেটা পুরোপুরি সফল করা যায় না। এ জন্য দেশের রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থাপনাকে যেমন দায়ী করা হচ্ছে, তেমনি রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে নানা রকম ছাড় দেওয়াকেও দায়ী করা হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফও রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাপনা সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছে। প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে, নতুন করদাতাদের শনাক্ত করে কর আদায়, মূল্য সংযোজন কর আদায়ে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।

অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, বর্তমান আর্থিক সংকটের জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করা হলেও আসলে আমাদের দেশেই দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক যে সব নীতি ও কৌশল নেওয়া হচ্ছিল, সেগুলোর অনেক প্রভাব রয়েছে। আর্থিক খাতে ঋণখেলাপি, সুশাসনের অভাব, ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি রয়েছে। বিভিন্ন সময় সংস্কারের যে সব তাগিদ দেওয়া হয়েছে, অনেক দিন ধরেই সে সব অবহেলিত রয়েছে। আইএমএফ কিছু সংস্কারের কথা বললেও তার কিছু বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বিশেষ করে ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাত খেলাপি ঋণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আইমএফের শর্তের মধ্যে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা এবং আর্থিক খাতের সংস্কারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণও বেড়েছে। রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে একটা পরিষ্কার কর্মপরিকল্পনা, আর্থিক খাতের ঋণখেলাপিসহ অব্যবস্থাপনা দূর করতে কী করা হবে, তার পরিষ্কার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।

সূত্র: জনকণ্ঠ