দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর হয়েগেল আমাদেও প্রিয়জন বাংলাদেশ বেতার রাজশাহীর ষ্টাফ আর্টিস্ট জনপ্রিয় শিল্পী সুলতানা রাজিয়া বেগম বুলা ( বেতারের নাম আবেদা বুবু)‘র আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া। ২০১৮ ২জুন দুপুরে তিনি আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আমি বেতারের একজন শিল্পী কাজেই তাকে ভিষন মনে পরে তিনি ছিলেন মিশুক একব্যক্তি তার জন্ম হয় তৎকালীন ভারত বর্ষের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে রেশম অফিসার নানা গোলাম আহাম্মেদের বাড়িতে। বাবা মরহুম জহির উদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, আইনজীবি, বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা। খুব ছোট থাকলেও সুলতানা রাজিয়া সেই সময়কার বড় বড় নেতাদের কাছে পেয়েছিলেন। একবার মিছিলে হারিয়ে গেলে তার বাবার কর্মীরা তাকে বাড়িতে পৌছে দেন। দেশবিভাগের পর মা-বাবা অন্যান্যদের সাথে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহীতে চলে আসেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। বই পড়তে তার প্রচন্ড ভাল লাগত। পড়াশোনা শুরু রাজশাহী পি.এন. স্কুলে, এরপর রাজশাহী কলেজে এই সময় যখন মেয়েদের শার্ট পড়া প্রচলন তেমন ছিল না তিনি তখন শার্ট পায়জামা পড়ে ছেলে সহপাঠীদের সাথে ক্লাস করতেন। ভাল শ্যূটার ছিলেন,ভাল গান্ও গাইতে পারতেন, এক পর্যায়ে সাঁতারেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। রাজশাহী প্রিপারেটি স্কুল পি.এন গার্লস স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করে বেতারে যুক্ত হলেন। ভাল ইংরেজি ও উর্দু বলতে পারতেন।
প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার মোতাহার হোসেনের ক্যামেরায় তোলা সুলতানা রাজিয়া বেগম বুলা‘র সেই ছবিটি।
বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা বেতারে যুক্ত হবার প্রস্তাব পান কিন্তু থেকে গেলেন রাজশাহীতেই। ওপার বাংলার শ্রোতাদের কাছেও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। কোলকাতা বেতার থেকে তাকে সেখানে যুক্ত হবার জন্য প্রস্তাব দেয়া হয়। সুলতানা রাজিয়া বেগম বুলা বাংলাদেশ বেতার রংপুরে ও দ্বায়িত্ব পালন করেন। রজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালের শিক্ষার্থী সুলতানা রাজিয়ার বড় ভাই বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব থাকার সময় দেশ পরিচালনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। আরেক ভাই মরহুম সাংবাদিক মঞ্জুরুল হক অনেকের ভাগ্য পরিবর্তনে ভুমিকা রেখেছেন। ছোট ভাই ওয়ালিউর রহমান বাবু সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, রেডিও, প্রযোজক, উপস্থাপক ও মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহে ভুমিকা রেখে চলেছেন। তার একাত্তরের স্মৃতিচারনে জানা যায় ২৫ মার্চ পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠলে তিনি বাড়ির পাশে থাকা ঘনিষ্টজন তৎকালীন রাজশাহী ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ সি.আই.বি‘র এ.ডি দুলাভাই খলিলুর রহমানের (শহীদ) কাছে পরামর্শ নিলেন। বড়ভাই বা অন্য কারও সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
২৮ মার্চ রাজশাহী পুলিশ লাইনের পতন হলে খলিলুর রহমানের পরামর্শে তিনি স্বজনদের নিয়ে গ্রামে চলে গেলে পারিবারিকভাবে পরিচিত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে দেখা করে তিনি বললেন পাশে আছেন, প্রয়োজনে একসাথে নিরাপদ স্থানে চলে যাবেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রামটি আক্রমন করলে পরিস্থিতির কারনে তাকে পাওয়া গেলো না। সীমান্ত পার হ্ওয়া সম্ভব না হ্ওয়ায় স্বজনদের নিয়ে রাজশাহী শহরে ফিরে এসে ঘনিষ্ঠজন খলিলুর রহমানকে পাকিস্তানী সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে জেনে প্রচন্ড কষ্ট পেয়ে অভিভাবকহীন হয়ে পড়লেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সহযোগী বীর মুক্তিযোদ্ধা রজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকত্যা দেওয়ান আব্দুল খালেকর সাথে তার যোগাযোগ চলতে থাকে । পাকিস্তানপন্থীরা তার উপর নজরদারি করছিলো সেটা তিনি পরে বুঝেছিলেন।
রাজশাহী বেতারকেন্দ্রে অনুষ্ঠানে বরণীয়া নগরপিতা এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটনের চাচা আব্দুস সামাদ , অনুষ্ঠানের হোসেন আলী মোকাদ্দম হোসেন ও অনুষ্ঠানের আবেদা বুবু সুলতানা রাজিয়া বেগম বুলা তিনজনেই না ফেরার দেশে।
দেওয়ান আব্দুল খালেক তাকে বিশেষ দায়িত্ব নেবার প্রস্তাব দেন। একদিন মধ্যরাতে রাজাকাররা তাদের বাড়ি ঘেরাও করলে তিনি তার ছোট ভাই বাবুকে নিয়ে সরে পরার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। রাজাকাররা তাদের বাড়ি থেকে অন্য একজনকে ধরে নিয়ে গেলো। পরে ভাগ্যক্রমে সে ফিরে আসে। দেওয়ান আব্দুল খালেককের সাথে সিদ্ধান্ত চুরান্ত হবার মুহুর্তে জানলেন পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পন করবে, বিজয় সন্নিকটে। ১৬ ডিসেম্বর সেই ঐতিহাসিক দিনে তিনি বেতারে বিশেষ দায়িত্ব পালন করলেন। এদিন মুক্তিযুদ্ধের একটি অগ্রনী দল সন্ধ্যায় তাদের বাড়িতে চা পান করলেন। ১৭ ডিসেম্বর মুক্তি ও মিত্র বাহিনী রাজশাহী শহরে প্রবেশের দিনেও তিনি বেতারে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। একদিন পর বীর মুক্তিযোদ্ধা ৭ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কমান্ডার কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান বীর উত্তমের মেয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা লায়লা, তার বোন, স্নেহের বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্ট্যান্ট বজলুর রশীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্ট্যান্ট কাইয়ুম তার সাথে দেখা করে দোয়া নেন। (তথ্য সুত্র আহম্মেদ সফিউদ্দিন সাবেক ডেপুটি রেজিঃ রাঃ বিঃ ও সমাজ চিন্তাবিদ )
বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী কেন্দ্রের ষ্টাফ আর্টিষ্ট জনপ্রিয় শিল্পী সুলতানা রাজিয়া বেগম বুলা‘র পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীতে পারিবারিকভাবে দিনটি পালিত হবে। বিভিন্ন স্থানে থাকা স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনরা দোয়া আয়োজনের মাধ্যমে দিনটি পালন করবে।
লেখকঃ সাংবাদিক, নাট্যব্যক্তিত্ব, চিত্রগ্রাহক সংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজ কর্মী ফোটোসাংবাদিক