ঢাকাশনিবার , ২৯ জুলাই ২০২৩
  • অন্যান্য

Independent Bengal Football Team

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আরও একটি ইতিহাস

  • ওয়ালিউর রহমান বাবু

    জুলাই ২৯, ২০২৩, ৪:৩৩ অপরাহ্ণ
ভারতের কলকাতার দুর্গাপুর ষ্টিলমিল মাঠে দুর্গাপুর ফুটবল একাদশের সাথে প্রদর্শনী ম্যাচে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলাররা। ছবি স্টুডিও চিত্রাশী ৮৯/১ মাহাত্না গান্ধী রোড কলকাতা সৌজন্যে- বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলার ফজলে সদাইন খোকন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৯ জুলাই একটি গুরুত্বপূর্ন দিন। এই দিনে সৃষ্টি হলো আরও একটি ইতিহাস। নির্বাচিত বাঙ্গালি নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পদক্ষেপ না নিয়ে ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল এহিয়া খানের পার্লামেন্ট স্থগিত সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেদিন ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলারত বাঙালি ক্রিকেটাররা এর প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ১ মার্চ থেকেই প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন ফুটবলারাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রতিরোধ সংগ্রামকে সংগঠিত করতে তারা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে থাকেন। সেই সেরা ব্যক্তিত্বরাও হলেন তৎকালীন পাকিস্তানের ফুটবল অঙ্গ কাঁপানো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজশাহী জেলার নওগাঁ মহকুমার জাকারিয়া পিন্টু (ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের অধিনায়ক, নাটোর মহকুমার গোপালপুরের শেখ তসলিম উদ্দিন (ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের অধিনায়ক) রাজশাহী জেলা সদরের ফজলে সদাইন খোকন (ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবের মিডিল ফিল্ড ফুটবলার) বগুড়া জেলার অমলেস সেন (ঢাকা পি ডাব্লু -ডি ক্লাবের রাইটিং ফুটবলার)। এই সেরা ব্যক্তিত্বরা তাদের সঙ্গীদের নিয়ে সৃষ্টি করলেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক ইতিহাস।

এপ্রিলের মাঝামাঝি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়া মোদী ক্রীড়া বান্ধবদের সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগে অংশ নেওয়া ফুটবলারদের কলকাতাস্থ ৯ সার্কাস এভিনিউ এর বাংলাদেশ মিশনে যোগাযোগের আহবান জানালে তারা সেখানে যোগাযোগ করলে, সীমান্তের ওপারে বাঙ্গালিপুর ক্যাম্পে শুরু হলো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল গঠনের প্রথম প্রক্রিয়া। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের লিখিত নির্দেশ পেয়ে জাকারিয়া পিন্টু কলকাতায় স্বাধীনতাকামী ফুটবলারদের সংগঠিত করতে থাকলে, চল্লিশ ফুটবলার সংগঠিত হলেন। পার্ক সার্কসে কোকাকোলা ভবনে অফিসের জন্য একটি ঘর নেয়া হলো । পার্ক সার্কাস মাঠে দুই দিনের বাছাই পর্বে মনোনীত করা হলো পঁচিশ জনকে। কোচ ও ম্যানেজারের দায়িত্ব দেয়া হলো ঢাকার নাম করা ফুটবল রেফারী ফুটবল ব্যক্তিত্ব ননী বসাক (নায়িকা সাবনমের বাবা) ও ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব তানভীর মাজহার তান্নাকে কে। এ দুজন সহ সে সময়ে ঢাকা ফুটবল লীগে অংশ নেয়া সেরা ফুটবল ব্যক্তিত্ব কাজী সালাউদ্দিন, শিরু, নওশের আলী, সুভাষ, সন্দিজ, আমিরুল ইসলাম, আব্দুল হাকিম, লুৎফর রহমান প্রমুখকে কাছে পেয়ে ফুটবলাররা অনুপ্রানিত হয়ে উঠেন। কোকাকোলা ভবনে করা অফিস ঘরের পাশে আরেকটি ঘরে ফুটবলারদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। নানা সমস্যা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জিবিত হয়ে ফুটবলাররা সব সমস্যা জয় করে ফেললেন । জাকারিয়া পিন্টুকে অধিনায়ক ও ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের রাইট আউট প্রতাব শংকর হাজরাকে সহ অধিনায়ক করে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যাত্রা শুরু হয়।

সিদ্ধান্ত হলো স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রদশনী ম্যাচে অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা তহবিলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করবে। চলতে থাকে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রশিক্ষন। নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার আয়োজনে দিন ক্ষন ঠিক হলো ২৯ জুলাই বিকেলে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে নদীয়া জেলা একাদশের সাথে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রদশনী ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। আয়োজকরা জোরে সরে চালাতে থাকেন প্রচার। ২৯ জুলাই ভৌর থেকে স্বাধীন বাংলা ফুটবলারদের মধ্যে মৃদু গুঞ্জন ঐতিহাসিক কিছু একটা করা হবে কিন্তু কি করা হবে তা কেউ জানতে পারলেন না। ব্যপারটি খুবই গোপনে সীমাবদ্ধ রাখা হয় মাত্র কয়েকজনের মধ্যে। নিদিষ্ট সময়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। বুকে মনোগ্রাম লেখা সবুজ কলার ও লাল বডির জার্সি পড়ে বিকেল ৪ টায় কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম মাঠে প্রবেশ করতেই করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। সে এক অভিভুত দৃশ্য। স্বাধীন বাংলা ফুটবলারদের মধ্যে টান টান উত্তেজনা। সারিবদ্ধ ভাবে জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি” গাইবার পর পরই অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও সহ অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরার (ঢাকা মহামেডান দলের রাইট আউট) নেতৃত্বে বৃহত্তর রাজশাহীর জেলার সাহসী কৃতি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব শেখ তসলিম উদ্দিন, ফজলে সদাইন খোকন, বগুড়ার অমলেস সেন অন্যান্যদের নিয়ে স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শক ও প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গকে অবাক করে দিয়ে সবুজের উপর লালবৃত্তে মানচিত্র আকা স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াতেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আলোড়িত হয়ে উঠে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে মাঠ প্রর্দশনের সময় দর্শকদের মাঝে থাকা রাজশাহী নাটোর, নওগা, বগুড়া রংপুর ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে সীমান্ত পার হয়ে যাওয়া স্বাধীনতাকামীরা জাকারিয়া পিন্টু, শেখ তসলিম উদ্দিন, অমলেস সেন, ফজলে সদাইন খোকন, আব্দুস সাত্তার ও অন্যান্যদের নাম ধরে চিৎকার করে উৎসাহ দিতে থাকে। এ এক অন্য রকম অনুভুতির। দেশের বাইরে পরিচিত কাওকে পেলে যেমনটি হয় ঠিক তেমনই এক অনুভূতি সেদিন সৃষ্টি হয় কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। পতাকা তোলার ব্যাপারটি নদীয়া প্রসাশনে ঝড় তুলে। খবরটি তখুনি চলে যায় ভারত সরকারের উচ্চমহলে। উদ্ধোধনী এই প্রদর্শণী ম্যাচে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নদীয়া একাদশের সাথে ২-২ গোলে ড্র করে ।

এই ম্যাচে অংশ নেয় ফুটবরারদের মতে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানো বিদেশে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উড়ানোর ঘটনা। বিদেশী প্রচার মাধ্যমে পতাকা উড়ানোর ঘটনাটি ঘটা করে প্রচার হয়। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ানোর খবর ছড়িয়ে পড়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে। মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প, শরনার্থী শিবিরে সাড়া পড়ে যায়। পতাকা উড়ানোর দায়ে ভারত সরকার নদীয়া জেলার ডিএম দীপক কান্তি ঘোঘকে চাকুরী থেকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত ও নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার এপিলিয়েশন বাতিল করা হয়। এনিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে পড়লেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা ভারতীয় জনগনের অফুরন্ত প্রসংসা পেয়ে তারা তাদের তৎপরতা অবহ্যত রাখেন। ভারতের বিভিন্ন অংশে ষোল টি প্রদর্শণী থেকে সংগ্রহ করা ভারতীয় প্রায় ৫ লক্ষ রুপি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তহবিলে জমা দেয়া হয়। ভারত সরকার কতৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পর স্বাধীন বাংলার পতাকা তোলার দায়ে বরখাস্ত হওয়া নদীয়া জেলা ডিএম দীপক কান্তি ঘোষ ফিরে পেলেন চাকুরি। ফিরিয়ে দেয়া হয় নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার এপিলিয়েশন ও। স্বাধীন বাংলার ফুটবল দলের ফুটবালারদের তথ্যে জানা যায়। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ঢাকা স্টেডিয়ামে বাছাই করা ফুটবলারদের নিয়ে গঠিত একাদশের সাথে প্রদশনী ম্যাচে অংশ নিয়ে অফুরন্ত প্রসংসা, শুভেচ্ছা পেলো। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখলেও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল রাষ্টীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয় যা দুভাগ্য জনক। ইতিমধ্যে অনেকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন তারা স্বাীকৃতির স্বাধ স্পর্শ করতে পারেননি। সরকার কতৃক বরাদ্দকৃত সম্মানীয়ও বাতিল করে দেয়া হয় পরবর্তিতে তা আবার প্রদান করে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে তরান্বিত করতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি গৌরবময় ইতিহাস। তথ্যসূথ্য : বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ফুটবলার ফজলে সদাইন খোকন।


লেখক মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, সমাজ ও সাংস্কৃতিক কর্মী।