টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কয়লার দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে শতাধিক ইটভাটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বেশ কিছু দিন ধরে শৈত্যপ্রবাহ এবং অসময়ের বৃষ্টিতে ইট পোড়াতে না পেরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঋণে জর্জরিত এসব ইটভাটা মালিকগণ চরম বিপাকে পরেছেন বলে অভিযোগ করেছেন। ভরা মৌসুমে কয়লার অভাবে ইট পোড়াতে না পেয়ে ভাটা মালিকরা দিশেহারা।
অপর দিকে পরিবেশে অধিদপ্তর থেকে কিছু কিছু ইটভাটাকে অনুমোদনপত্র দিচ্ছে না। বিপুল অংকের টাকা বিনিয়োগ করেও কয়লার এক দিকে কয়লার অভাব, অপর দিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের নানা কারসাজির কারণে এ বছর ইটভাটা চালু করতে পারছেন না বলে ইটভাটা মালিকরা অভিযোগ করেছেন। উপজেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন কয়লার দাম টনপ্রতি ১৫-১৬ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলার কয়েকটি এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কয়লার অভাবে ইটভাটায় লাখ লাখ কাঁচা ইট জমে রয়েছে।
আজ শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) উপজেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতি সূত্র জানায়, মির্জাপুর উপজেলায় একটি পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নে পরিবেশবান্ধব শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। এদের মধ্যে ৯৮ ভাটার সরকারি অনুমোদন রয়েছেন। এসব ভাটায় সরকারি নিয়ম মেনেই কয়লা দিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। কয়লা মূলত ইন্দোনেশিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করতে হয়। এ বছর কয়লা আমদানি নিয়ে নানা সমস্যা হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে এক টন কয়লা ৭-৮ হাজার টাকা দাম বেড়ে হয়েছে ২২-২৪ হাজার টাকা। এসব ভাটা থেকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব পেয়ে আসছেন। গত ১০-৩০ বছরের ব্যবধানে ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি ও ভাড়া জমি নিয়ে এসব ইটভাটা গড়ে উঠলেও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এসব ইটভাটা এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ইটভাটায় প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক-কর্মচারীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলার বাইমহাটি, মহেড়া, জামুর্কি, ফতেপুর, ভাওড়া, ভাদগ্রাম, গোড়াই. লতিফপুর, আজগানা, তরফপুর ও বাঁশতৈল ইউনিয়নে এসব ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। শিল্পাঞ্চল ও পাহাড়ি এলাকা গোড়াই, দেওহাটা, কোদালিয়া, সোহাগপুর, সৈয়দপুর, বহুরিয়া, হাটুভাঙ্গা, বেলতৈল, নয়াপাড়া, বাঁশতৈল, খাটিয়ারঘাট এলাকায় রয়েছে অন্তত ৩০-৪০ ইটভাটা।
উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. আতিকুল ইসলাম সিকদার, সাধারণ সম্পাদক হাজি মোক্তার আলী সিদ্দিকী বলেন, ইটভাটা একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। গত ১০-৩০ বছরের ব্যবধানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র এবং জেলা প্রশাসনের ইট পোড়ানোর লাইসেন্স গ্রহণ করে ইটভাটা স্থাপন করা হয়। প্রথমে টিন চিমনি, পরবর্তীকালে ১২০ ফুট উঁচু ফিক্সড চিমনি ও ২০১৩-এর ২(ঘ) জালানিসাশ্রয়ী উন্নত প্রযুক্তি সম্পন্ন হাইব্রিড, হফম্যান, কিলন, জিগজ্যাগ, ভ্যাটিক্যাল স্যাফট ফিলনসহ সরকারি ভাবে ইটভাটা আইন জারি হলে ১২০ ফুট চিমনি ভেঙে পরিবেশবান্ধব ইটভাটা স্থাপন করা হয়। এখন এসব ভাটায় কাঠ, বাঁশ ব্যবহার হচ্ছে না এবং পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। লাখ লাখ টাকা খরচ করে চিমনি পরিবর্তন করা হয়। এসব ইটভাটা এখন পরিবেশেরও কোনো ক্ষতি করছে না। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন ২০১৯-এর (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) শিথিল হলেও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় ইটভাটা মালিকরা এখন চরম বিপাকে পরেছেন। এই শিল্পের সঙ্গে সরকার ও দেশের অনেক উন্নয়ন চিত্র জড়িত।
উপজেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক ইব্রাহিম মিয়া, আবু সাইদ মিয়া, মোশারফ হোসেন ও ছানোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, মির্জাপুর উপজেলায় সরকারি বিধি অনুযায়ী পরিবেশ বান্ধব জিকজ্যাক ইটভাটায় উন্নত মানের ইট পোড়োনো হয়। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে একজন ইটভাটা মালিক জীবনের কষ্ঠার্জিত সমস্ত অর্থ ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে একটি ইটভাটা স্থাপন করলেও তাদের হয়নারি শিকার হতে হচ্ছে। ২০১৩ সালের আইন বাস্তবায়ন না করে পরিবেশ অধিদপ্তর এখন তাদের ছাড়পত্র দিচ্ছে না। তাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। গত বছর কয়লার দাম ছিল প্রতি টন ৯-১১ হাজার টাকা। চলতি বছর এক টন কয়লার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকা। গত বছর এক হাজার ইটের দাম ছিল ১০-১১ হাজার টাকা। কয়লাসহ জালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় এ বছর এক হাজার ইটের খরচ পরবে ১১-১৩ হাজার টাকা। ভরা মৌসুম শুরু হলেও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কয়েক দিন হলো ইটভাটা চালু হলেও একন টানা বৃষ্টিতে তাদের কপাল পুড়ে গেছে। বৃষ্টির পানিতে ইট নষ্ট হয়ে চরম বিপাকে এবং কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফিরোজ হায়দার খান ও মির্জাপুর উপজেলা ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির আহ্বায়ক মো. মঞ্জুরুল কাদের বাবুল বলেন, কয়লার দামসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে উপজেলার ৯৮ ইটভাটা মালিক ঋণে জর্জরিত হয়ে পথে বসার উপক্রম হয়েছে। এখন নতুন করে যোগ হচ্ছে অসময়ে টানা বৃষ্টি। দফায় দফায় জালানির দাম বৃদ্ধি ও পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র না দেওয়ায় ইটভাটা চালু করা যাচ্ছে না। ঋণের চাপে তারা মরার উপক্রম হয়েছে। তাদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এই শিল্পের সঙ্গে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে যাচ্ছে। সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে তারা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। ইটভাটা চালু ও ছাড়পত্রসহ লাইসেন্স প্রদানের জন্য তিনি সরকারের সঙ্গে জোর দাবি জানিয়েছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তর টাঙ্গাইলের কর্মকর্তা বিপ্লব বলেন, মির্জাপুর উপজেলায় বেশ কিছু ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স রয়েছে। যাদের ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স নেই তারা ইটভাটা চালাতে পারবে না। সরকার ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দিলে তাদের ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।