শাস্ত্রীয় সংগীতের মহীরুহ, কিংবদন্তি রশিদ খান চলে গেলেন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে মারা যাওয়া এই কিংবদন্তির মৃত্যুতে সারা পৃথিবীর সংগীত তারকারা শোকস্তব্ধ হয়েছেন। করেছেন শোক প্রকাশ। ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা ছিল শিল্পী তপন চৌধুরীর। তারই কিছু অমূল্য স্মৃতি নিয়ে আজকের মূল প্রতিবেদন। অনুলিখন করেছেন তানভীর তারেক
প্রথম দিল্লিতে একটি শাস্ত্রীয় সংগীত উত্সবে দেখা হয় রশিদ খানের সাথে। তখনও রশিদ খানের নামটি চারদিকে ছড়িয়ে যায়নি। পুরো অনুষ্ঠানের শেষভাগের পারফর্মার ছিলেন তিনি। দিল্লিতে আমি আর সুবীরদা একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। আমাদের অনুষ্ঠান শেষ করে সুবীরদা (প্রয়াত সুবীর নন্দী ) বললেন, চলো গান শুনে আসি। সুবীরদা যেমন এই উপমহাদেশের কিংবদন্তি শিল্পী ছিলেন, তেমনি আমার দেখা পৃথিবীর সেরা শ্রোতা তিনি। সারাদিনে তিনি যে কতরকম গান শুনতেন তার কোনো হিসেব নেই। কোথাও গেলে কোনো অনুষ্ঠান বাদ দিতেন না সুবীরদা। যাই হোক আমি আর সুবীরদা রওনা হলাম।
অডিটরিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। অনেক বিখ্যাত মিউজিশিয়ান বাজাবেন, গাইবেন। কিন্তু পাশ থেকে বেশ ক’জন রশিদ খানের গান শোনার আকুলতা জানাচ্ছেন। আমি সেই প্রথম রশিদ খান সম্পর্কে জানলাম। সুবীরদাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি চিনলেন। আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগের কথা বলছি। সুবীরদা বললেন, ও রাইজিং স্টার। এখানে অনেকেই ওর ভক্ত। এরপর প্রথম সে অনুষ্ঠানে তাকে দেখলাম। একজন দর্শক হিসেবে। মুগ্ধতা ছুঁয়ে গেল বললে কম বলা হবে। বলা উচিত—সুরের মুগ্ধতার অপর নাম ‘ওস্তাদ রশিদ খান’। কারো কারো মৃত্যুতে শোকস্তব্ধতা হয়। তার মৃত্যুতে তেমনই থমকে গেলাম!
হয়তো ভাবছেন একজন দর্শক হিসেবে এমন মহীরুহ’র প্রতি কেন এত মায়া জন্মাবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, যদি পরবর্তীকালে আর কোনোদিন তার সাথে দেখা নাও হতো—তবু এই মানুষটার প্রতি অনুরাগ এতটুকুও কমতো না। কারণ সেই রাতে গান শোনার পর, মনে হলো এভাবেও কোনো মানুষ গাইতে পারে! এভাবেও গাওয়া যায়। এভাবেও একেকটা রাগে কীভাবে শ্রোতাদের বুঁদ করে রাখা যায়! এরপর থেকে এই মানুষটার প্রতি যে অনুরাগ তৈরি হলো, তা আজও বিদ্যমান।
পাঞ্জাবি চেয়েছিলেন রশিদ খান!
এবারের সাক্ষাতেও সুবীরদার সঙ্গী আমি। ততদিনে সুবীরদার সাথে দারুণ সখ্য হয়ে গেছে রাশিদ খানের। মাঝে মাঝে তাদের কথা হয়। যাই হোক ঢাকায় এসেছেন রশিদ খান। সুবীরদা অজয়দা ও রশিদ খানের জন্য দুটো করে ৪ টা পাঞ্জাবি কিনেছেন। যেকোনো অবসরে সুবীরদার আমি ছায়াসঙ্গী। যাই হোক, পাঞ্জাবি তো একটা উছিলা মাত্র। আমাদের সাথে সাক্ষাত্ হবে, একসাথে আড্ডা হবে। সেই লোভটা তো সংবরণ করা মুশকিল। তাই ব্যক্তিগত কিছু কাজ থাকলেও আমি রাজি হলাম। বললাম আমাকেও সঙ্গে নিয়েন।
তারা ৫ তারকা হোটেলে উঠেছেন। সুবীরদা এসেছে শুনেই রশিদ খান নিচে নেমে এলেন। ফোনে ওপার থেকে বললেন,‘ওনারা যেন একা ওপরে না আসেন।’
কেন আমাদের তখনই যেতে নিষেধ করলেন বুঝলাম না। কিছুক্ষণ পর রশিদ খান নিজেই নেমে এলেন, বললেন আপনাকে একা আসতে বলাটা অভদ্রতা। রুমে রশিদ খানের একজন বন্ধু ছিলেন। তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বললেন বাংলা গানের দুই মাস্টারপিস। একজন শিল্পীর এহেন বিনয় দেখে সত্যিই অবাক হলাম। ভাবলাম এমনি এমনি একজন পণ্ডিত মহীরুহ হয় না। এতগুলো গুণ থাকলেই তা সম্ভব হয়ে ওঠে। আমাদের অনেকক্ষণ ধরে কথা হলো। কথার ফাঁকে রশিদ খান দাদার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে এলেন। বললেন, ‘আমার সাইজ কীভাবে ঠিক ঠাক বুঝলেন, সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি। অনেকেই আমাকে পাঞ্জাবি দিয়েছে এ যাবত। কিন্তু অধিকাংশই আমার সাইজে হয় না। রশিদ খান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ঐ বেসাইজ মানুষ হলে যা হয়, বুঝলেন তো!’
আমি তাকে বললাম,‘যে মানুষটা সুরের ক্ষেত্রে এত নিখুঁত সাইজের। তার ওসব সাইজের হিসেব দরকার হয় না দাদা।’ জবাবটা খুব দারুণ দিলেন তিনি! বললেন, ঐটুকুনের জন্যই তো এই বেঢপ মানুষটাকে লোকে মেনে নেয়।’ আমাদের রুমের সকলেরই হাসির রোল পড়ে গেল। আমাকে একটি সুভ্যেনিয়র আর সুবীরদাকে একটি পাঞ্জাবি গিফট করলেন রশিদ খান। এত নির্মল একটা আড্ডা হলো। ভুলতে পারলাম না। ঢাকার সারাবেলা রিকশায় ঘুরলেন! ঢাকায় একাধিকবার এসেছেন ওস্তাদ রশিদ খান। ঢাকায় এলেই আসাফ উদ দৌলা ভাইয়ের বাসায় উঠতেন তিনি। ভীষণ ভোজন রসিক ছিলেন। খুব সাধারণ মানুষের মতো ঘুরতেন। একবার সকাল বেলা দেখা হলো একটা মিটিংয়ে। খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, তপনদা আমার সাথে চলুন তো একটা জায়গায়।
আমি ভাবলাম, ঢাকায় আবার কোথায় যাবেন তিনি? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাবেন? আমি তাহলে গাড়ি আসতে বলি। বললেন , না না। কোনো গাড়ি লাগবে না। বলেই আমরা দুজন বের হলাম।
রশিদ খান নিজেই রিকশা ডাকলেন। এরপর বললেন, সারাদিন আমার সাথে ঘুরবে। আমি আর রশিদ খান রিকশায় উঠলাম। রিকশাওয়ালা আমাকে চিনলেন। আমি লজ্জায় পড়ে গেলাম। বললাম, এই মানুষটাকে চিনো তুমি? কে যে আজ তোমার গাড়িতে উঠেছে, তা যদি বুঝতিরে পাগলা। রিকশাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে রশিদ খানকে দেখতে লাগলেন। চিনতে না পেরে আবার রিকশা চালানোয় মন দিলেন।
রাশিদ খান বললেন, ‘এই একটা সুবিধা আমার। আমি সাধারণের ভেতরেও খুব দারুণ মিশতে পারি। তোমাদের মতো গুণী মানুষেরা আমাকে একআধটু চেনে আরকি! মানুষের এমন বিনয় আমাকে বারবার মুগ্ধ করতো। আমরা প্রায় পুরো বেলা ঘুরলাম। দুপুরে বিরিয়ানি খেতে চাইলেন। খুব মজা করে খেলেন। রিকশাওয়ালাকে ডাকলেন। তিনি যা যা খেলেন সেগুলোই ওনার জন্য অর্ডার দিলেন। আমার জীবনে স্মরণীয় একটা দিন তিনি উপহার দিলেন। আমি রিকশাওয়ালাকে একটু কম ট্রাফিক জ্যাম হয়—এমন রাস্তায় নিয়ে গেলাম। নানান গল্প বললেন, সরল মনে। যেমন আমাদের দুজনার অনেকদিনের সখ্য। পুরোনো বন্ধুত্ব।
একজন মানুষ কতটা সরল, বিনয়ী অকপট হলে তা সম্ভব। এক অসাধারণ মুহূর্ত দিলেন। তার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তাই নিজেকে নিজে বোঝাতে পারিনি। কিছু কিছু বিয়োগ মেনে নেওয়া মুশকিল। এমন স্বর্ণকণ্ঠ আর পৃথিবীতে আসবেন না। মনে হতো তিনি একেবারে ভেতর থেকে গাইছেন। আত্মার সুধারস-ই তার কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছে।
ক্যারিয়ারে এত অল্প বয়সে তিনি শাস্ত্রীয় সংগীতের এত উঁচু স্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন—যা সবার কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। নয়তো ৫৫ বছর বয়স তো একজন শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীর ক্যারিয়ারের মধ্যগগন। কিন্তু মৃত্যু যে অনিবার্য। গত প্রায় ১ দশক ধরে তিনি মেইন স্ট্রিমে গান গেয়েছেন। একইভাবে তারকা শিল্পীদের সাথে বলিউডে গেয়েছেন। মাই নেম ইজ খান ছবিতে শাহরুখ খান নিজে থেকেই একজন শিল্পীর গান রাখার জন্য বলেছিলেন। তিনি রশিদ খান। তার আগে একটি অনুষ্ঠানে তার পারফরম্যান্স দেখে শাহরুখ বলেছিলেন, আমার মুভিতে কি আপনি গাইবেন?
তিনি বলেছিলেন কেন গাইবো না। গাইতেই তো এসেছি এই পৃথিবীতে। পরে ১ টি গান গাইবার কথা থাকলেও প্রোডাকশন তার দুটি গান রেকর্ড করলেন। পেমেন্টের কথা কিছুই বলেননি শাহরুখ। শাহরুখ নিজ হাতে একটি ব্ল্যাংক চেক এগিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি বসিয়ে নেবেন।
রশিদ খান চেকটি ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, আপনার চোখের সমীহটুকুই থাক। চেকটা ফেরত নিয়ে যান প্লিজ। এমন মহীরুহ’র বিদায় শুধু আক্ষেপই জাগায় না। আফসোস হয়, এই সংগীতের পৃথিবীতে তার আরো কতকিছু দেবার ছিল। ভালো থাকবেন রশিদ খান। আপনার গানগুলো দিয়েই আমাদের সকালগুলো বা সন্ধ্যাগুলো সুন্দর হয়ে ওঠে।