আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, মঙ্গলবার, মে ২১, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Monetary Policy vs. Inflation

মুদ্রানীতি বনাম মূল্যস্ফীতি

Bijoy Bangla

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৮ জানুয়ারী, ২০২৪, ১২:২৪ পিএম

মুদ্রানীতি বনাম মূল্যস্ফীতি

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অভিঘাতে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি, তারল্য সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হারে লাগাম টানাসহ বহুমুখী চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে প্রবৃদ্ধির ধারাকে অব্যাহত রেখে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমাার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সংকোচনমূলক নতুন মুদ্রানীতি ১৭ জানুয়ারি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ,  বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে এর একটি পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।

প্রাথমিকভাবে নতুন মুদ্রানীতিতে তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় আনা হয়েছে। প্রথমত, নীতি সুদহার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে; দ্বিতীয়ত, রিভার্স রেপো (বর্তমান নাম স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি বা এসডিএফ) নিম্নসীমার সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে।

যার ফলে বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়। তৃতীয়ত, নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। যার ফলে সংকটে পড়া ব্যাংকের বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে।

নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নিম্নসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি সুদহার আট শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা।

সংকোচনমূলক এ মুদ্রানীতি ঘোষণায় বলা হয়েছে আমদানিতে ডলারের দাম ১১০ টাকায় রাখা গেছে, যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এখনো কম, এ সময়ে আমদানি কমেছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ ছিল ফলে রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে রয়েছে; ঘোষিত মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহার (রেপোরেট) ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ উন্নীত করে বাজারে মুদ্রা প্রবাহ হ্রাস করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ কার্যকর হবে; মুদ্রা বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনয়নে, ‘ক্রগিং পেগ’ পদ্ধতি বাজারকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হবে, তবে এর জন্য কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

উপরন্তু বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমাতে রায়ার্স ক্রেডিট, ইউজেন্স এলসি, ডেফার্ড পেমেন্ট এবং এক্সপোর্ট ফ্যাক্টরিং প্রভৃতি বিষয় বিকল্প উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। দেশে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে তারল্য বৃদ্ধিকল্পে ‘এক্সপোর্টার রিটেনশন কোটা (ইআরকিউ)’ হার পূর্বের ১৫, ৬০ এবং ৭০ শতাংশের তুলনায় যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫, ৩০ এবং ৩৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে।

এ ছাড়াও পেমেন্টের ক্ষেত্রে রেগুলেটরি ক্যাপিটালের ৪০ শতাংশ অফশোর ব্যাংকিং অপারেশন্স হতে ধারের সুযোগ দেওয়া হয়েছে; এ উদ্যোগ বিদ্যমান বৈদেশিক মুদ্রার পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করবে, যদিও সীমিত হস্তক্ষেপ এবং সুসংগঠিত নীতিকাঠামোর আওতায়  বৈদেশিক মুদ্রার বাজারকে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ প্রয়োজন হবে।

একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সংকোচনমূলক নীতি নেওয়া হয় চাহিদাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে সরবরাহজনিত মূল্যস্ফীতি যেখানে চাহিদার ভূমিকা অল্প। এ ধরনের মুদ্রানীতির ফলে ছোট, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতএব বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত একটি পলিসি স্টেটমেন্ট দেওয়া অর্থাৎ এখন থেকে যে ঋণ অনুমোদন হবে তার বড় অংশ যেন যায় এসএমইতে। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে উৎপাদনশীল খাত এসএমই।

এরা বাজারে পণ্য ও সেবা বাড়াবে যা মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমতে সহায়ক হবে। মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে। শুধু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করলে বড় কিছু হবে না কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট এখন নেতিবাচক। রপ্তানি আয় বাড়ানো ও বৈচিত্র্যকরণের জন্য কিছু পলিসি দরকার ছিল মুদ্রানীতিতে। তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে রপ্তানি উৎসাহিত করতে প্রণোদনা থাকলে ভালো হতো।

শুধু মূল্যস্ফীতি কমানো হবে আর অন্যক্ষেত্রে কিছু করা হবে না, এতে আংশিক সমস্যার সমাধান হবে। বিষয়টা হলো, সার্বিকভাবে সমস্যার গভীরে গিয়ে তা সমাধানের চেষ্টা করা। 

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থনীতিতে একটা তত্ত্ব আছে যে, অর্থনীতিতে মুদ্রার বেশি সরবরাহ হলে মূল্যস্ফীতি হবে যা সম্পূর্ণরূপে সত্যি না, তবে মুদ্রা যদি বেশি হয়, টাকা পাচারও যদি বেশি হয় তাহলে মূল্যস্ফীতি হবে। সুদহার শ্রেফ বাড়িয়ে দিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়, বরং সরবরাহ বাড়াতে হবে।

এজন্য সিলেক্টিভ বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষক, পোলট্রি, ফিশারিজ, ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি ব্যবসায়ীদের কম সুদে টাকা সরবরাহ করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিফাইন্যান্সিং বা পুনঃঅর্থায়ন আসতে হবে এবং সেখানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রয়োজন পড়বে না। বরং এসব খাতে যদি ঋণপ্রবাহ বাড়ানো যায় তাহলে বাজারে সরবরাহ বাড়বে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক এককভাবে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারবে না বরং বাণিজ্য, খাদ্য ও কৃষি-এ তিন মন্ত্রণালয়কে সমন্বিতভাবে চেষ্টা করতে হবে। বাজারে সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত না করে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। রেপো রিভার্স রেট বৃদ্ধিতে হয়তো যারা অল্প সুদে টাকা-পয়সা নিয়ে ডাইভার্ট করছে, অন্য জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, টাকা ব্যবহার করছে না, তারা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে।

অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদহার বৃদ্ধি আংশিকভাবে সফল নীতি, পুরোপুরি নয়। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোও সর্বোচ্চ আড়াই শতাংশ দিচ্ছে। যারা রেমিট্যান্স পাঠায় তারা যে এতে বেশি সুবিধা পায় এমন নয়। দেশ থেকে অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারলে অফিশিয়াল চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বাড়ানো যাবে না। রফতানি করলে বোনাস হিসেবে বেশি টাকা দেওয়া হবে। বিভিন্ন সময়ে এ রকম পলিসি নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বড় কোনো লাভ নেই, বরং ডলার রেটটা যদি বাজারভিত্তিক করা হয় তাহলে কাজে আসবে। আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পেয়েও দেখা গেছে হুন্ডির তুলনায় অনেক পেছনে, এতে হুন্ডি কমানো যাচ্ছে না। মাল্টিপল রেট না রেখে একক রেট রাখতে হবে, এটা বাজারে ছেড়ে দেওয়া উচিত ছিল। প্রয়োজনে তখন একটা সার্কিট ব্রেকার দেওয়া যেতে পারে। ডলারের দাম এর বেশি তোলা যাবে না। রেমিট্যান্স পাঠানো সহজতর করতে হবে। এখন অফিশিয়াল চ্যানেলে টাকা পাঠানো হয়তো হুন্ডির মতো সহজ করা যাবে না।

কিন্তু খরচ একটু কমাতে হবে এবং লেনদেনটা দ্রুততর করতে হবে। আজকের এ জায়গায় আসার পেছনে পলিসিগত দুর্বলতা প্রধানত দায়ী। সঠিক সময়ে সঠিক পলিসি নিলে এ সমস্যাগুলো হতো না। ছয়-নয় সুদের হার নির্ধারণও একটা ভুল পলিসি। বলা হচ্ছে, বড় ব্যবসায়ীদের চাপে পড়ে এমন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, সুদ তো ব্যবসায়ীদের একমাত্র ব্যয় নয়। সুদ ছাড়াও আরও অনেক ব্যয় আছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পরিবহন ব্যয়ও আছে।

ছয়-নয় সুদের ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। সময় এসেছে এগুলো শোধরানোর। আর্থিক খাতের সংস্কার ও তাকে পুনরুজ্জীবিত করার (ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও পুঁজিবাজার) সময় এসেছে ও এর সঙ্গে  বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থাপনারও উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0