আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, শনিবার, মে ১৮, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Suchitra Sen

নায়িকা থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

Bijoy Bangla

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৫:১৮ পিএম

নায়িকা থেকে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন

নায়িকা থেকে মহানায়িকা, রমা দাশগুপ্ত থেকে উপমহাদেশের আপামর দর্শককুলের নায়িকা হয়ে ওঠেন সুচিত্রা সেন। বাংলা, হিন্দি উভয় ভাষার চলচ্চিত্রেই অভিনয়ের মাধ্যমে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি। অভিনয় জগতের অন্যতম একজন জনপ্রিয় মুখ, একজন খাঁটি অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। অভিনয় অনেকেই করেন কিন্তু সুচিত্রা সেন সবাই হন না, হতে পারেন না। নন্দিত এই অভিনয়শিল্পীর জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল। একজন মানুষ কীভাবে মূল্যায়িত হবেন, তা নির্ভর করে তার কর্মের ওপর। যিনি যে কাজে নিয়োজিত বিশেষ করে সৃষ্টিশীল কাজ; সেখানে তিনি কতটা দক্ষতার ছাপ রাখছেন বা নিজস্বতা সৃষ্টি করছেন, তার ওপর নির্ভর করে তিনি কীভাবে মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নেবেন।

সুচিত্রা সেন একেবারেই নিজস্বতা বা আলাদা বৈশিষ্ট্য দিয়ে অভিনয় করে গেছেন চলচ্চিত্রে। একের পর এক জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন। আসলে অভিনয়টা ছিল তার স্বভাবজাত। একসময় এবং আজও রোমান্টিক সিনেমার জুটি বলতেই উত্তম-সুচিত্রা। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে অভিনয় দ্বারা মুগ্ধ করেছেন দর্শকদের। তার অভিনয়ে নিজস্বতার ধারা এতটাই জনপ্রিয় যে তা দর্শকদের চোখ জুড়িয়েছে। তার মিষ্টি মুখের সাথে অভিনয় দক্ষতা এই দুইয়ে তিনি অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। অভিনয়ে স্বার্থকতা এনেছে। দর্শক তার অভিনয় দেখে আনন্দ পেয়েছেন। সেই সাদা কালোর যুগ থেকে আজ পর্যন্তও তিনি জাদুকরের মতো মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন দর্শকদের।

সুচিত্রা সেনের জন্ম হয় পাবনায়। এই শহরেই তার জীবনের পড়ালেখা শুরু হয়। বড় হয়ে ওঠেন শহরের আলো হাওয়ায়। তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং তার মা ছিলেন আর দশজনের মতো গৃহবধূ। তার আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি ছিলেন কবি রজনীকান্তের নাতনি। ১৯৪৭ সালে শিল্পপতি আদিনাথ সেনের ছেলে দিবানাথ সেনের সঙ্গে সুচিত্রা সেনের বিয়ে হয়। এর পাঁচ বছর পর সুচিত্রা সেনের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল ‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৫২ সালে তিনি এই সিনেমার মাধ্যমে অভিনয় জগতে নাম লেখান। কিন্তু তার প্রথম সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। শেষ পর্যন্ত শেষ কোথায় সিনেমাটি আর শেষ হয়নি।

তার উত্থানের চলচ্চিত্রটির নাম ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। এই সিমেনায় তিনি মহানায়ক উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেন। এই সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে একটানা ৬৫ দিন ধরে চলেছিল। এটা রেকর্ড। এই জুটি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের আইকন জুটি। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে উত্তম কুমার আর সুচিত্রা সেনের মতো জনপ্রিয় জুটি আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। অনেক জুটি তৈরি হয়েছে আবার জনপ্রিয়তা কমে গেছে। বিশেষত রোমান্টিক জুটিগুলো খুব বেশি স্থায়ী হয় না। কিন্তু এই জুটি শেষ পর্যন্ত দর্শকদের ধরে রাখতে পেরেছিল। দর্শকরা কখনোই তাদের প্রতি আগ্রহ হারাননি। এই রোমান্টিক জুটিকে তাই অভিনয়ের ম্যাজিক বলা যায়। তাদের এই জনপ্রিয় জুটিকে সিলভার জুটি বলা হতো। ১৯৫৫ সালে তিনি হিন্দি সিনেমায় অভিনয় শুরু করেন। সেখানেও তিনি তার দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। সৃষ্টিশীল কাজ আসলে এমন একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি, তার বিকল্প কোনো শক্তি দিয়ে তা পূরণ করা যায় না। আর সুচিত্রা সেনের মতো মহানায়িকার তো নয়ই।

একজন লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে কাছে টানেন। আবার সেই পাঠক যখন দর্শক হয়ে টিভি সেটের সামনে বসে অভিনয় দেখেন; তখন তাকে কাছে টানেন একজন অভিনেতা-অভিনেত্রী। কাগজের প্রতিটি স্ক্রিপ্ট সার্থক হয়ে উঠেছিল সুচিত্রা সেনের অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে। অভিনয়ের সাফল্য দর্শককে কাছে টানার মাধ্যমে। খুব কম সংখ্যক এমন প্রতিভাসম্পন্ন অভিনেত্রী থাকেন; যারা সুচিত্রা সেনের মতো দর্শককে নিজের অভিনয় জাদুতে মুগ্ধ রেখেছেন বছরের পর বছর। তার শুরু থেকে শেষ অবধি সেই জনপ্রিয়তা। কোনো সিনেমায় তিনি থাকা অর্থই হলো সেই অভিনয় দেখার সুযোগ পাওয়া, যা দেখার জন্য দর্শক অপেক্ষা করে থাকেন। ঠিক এসব কারণেই তিনি অভিনয় জগতের একজন কিংবদন্তি। রমা দাশগুপ্ত থেকে কীভাবে একজন সুচিত্রা সেন হয়ে ওঠা যায় এবং শেষ পর্যন্ত তার পারিবারিক নাম ঢেকে গিয়ে তার অভিনয়ের সময়ের নাম মানুষের মনে জেগে থাকে, তার বড় উদাহরণ সুচিত্রা সেন।

ওপার বাংলার নায়িকা হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি মূলত পাবনার মেয়ে। পাবনা জেলা শহরের গোপালপুর মহল্লার হেমসাগর লেনে তার পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িতেই তার জন্ম ও শৈশব কেটেছে। বর্তমানে মহানায়িকার বাড়িতে রয়েছে ‘কিংবদন্তী মহানায়িকা সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংগ্রহশালা’। এখানে তার বিভিন্ন ছবি, জীবনের বিভিন্ন সময়ের তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড, সিনেমার পোস্টার ইত্যাদি নানা নিদর্শন রয়েছে। এই যে এপার-ওপার বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে তিনি রমা থেকে সুচিত্রা হয়ে হৃদয়ে ঠাঁই পেয়েছেন, তার থেকে বড় কোনো পুরস্কার হতে পারে না। তবে সুচিত্রা সেন তার অনবদ্য অভিনয়ের জন্য বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭৪ সালে তার অভিনীত ‘আন্ধি’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে মনোনয়ন পান। ১৯৬৩ সালে সুচিত্রা সেনের অভিনীত ‘সাত পাকে বাঁধা’ চলচ্চিত্রের জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেন।

তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস পুরস্কার অর্জন করেছিলেন। তিনিই ছিলেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী। ২০১২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত হন। ২০০৫ সালে হিন্দি চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কারে মনোনয়ন পেলেও তিনি তা গ্রহণ করতে আপত্তি জানান। এছাড়া ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রী, ১৯৭২ সালে পদ্মশ্রী অর্জন করেন। যে কোনো অভিনেত্রীর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হলো মানুষের ভালোবাসা। তা তিনি পেয়েছেন সারাজীবন। তিনি যেমন তার দক্ষতার সবটুকু দিয়ে চলচ্চিত্রকে উজাড় করে দিয়েছেন, চলচ্চিত্রকে যেমন প্রাণ দিয়েছেন; সেভাবেই মানুষ তাকে ভালোবেসেছে উজাড় করে।

দীর্ঘ ২৫ বছর অভিনয়ের পর তিনি চলচ্চিত্র থেকে অবসর নেন। তিনি চলচ্চিত্র থেকে চলে গেলেও মানুষের মনে, মুখে মুখে ঠিকই থেকে গেলেন। তার সাথে তুলনা করার কেউ নেই। কোনোদিন হবেও না। অভিনয় যে মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম, তা তিনি দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রমাণ করে গেছেন। নিজেকে তার অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যেখানে আজ তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার অসংখ্য অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘সাত নম্বর কয়েদী’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য’, ‘কাজরী’, ‘ঢুলি’, ‘মরণের পরে’, ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’, ‘অগ্নিপরীক্ষা’, ‘সাঁঝের প্রদীপ’, ‘গৃহপ্রদীপ’সহ আরও অনেক বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র।

তিনি ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেন। তবে তিনি চলে গেলেও মানুষের হৃদয়ে রয়ে গেছেন। মহানায়িকার মৃত্যুদিনে রইলো গভীর শ্রদ্ধা।


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0