আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, সোমবার, মে ২০, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Sundarban fire

সুন্দরবনের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে॥ নির্বাপন কাজের সমাপ্তি ঘোষনা

Bijoy Bangla

অনলাইন ডেস্ক:

প্রকাশিত: ০৮ মে, ২০২৪, ১০:৩৮ পিএম

সুন্দরবনের আগুন সম্পূর্ণ নিভেছে॥ নির্বাপন কাজের সমাপ্তি ঘোষনা
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আমরবুনিয়া এলাকার আগুন বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিভে গেছে।.....সংগৃহীত ছবি

তিনদিন ধরে জ্বলতে থাকা সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আমরবুনিয়া এলাকার আগুন বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিভে গেছে। কোথাও আগুন এমনকি ধোঁয়াও নেই। তবে অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য মঙ্গলবার সকাল থেকে বনের মধ্যে ড্রোনের মাধ্যমে আগুন ও ধোয়া অনুসন্ধান কাজ করছে বনকর্মী ও স্থানীয়রা। 

এ অনুসন্ধান চলে সন্ধ্যাপর্যন্ত। এরপর অনুসন্ধান কাজের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।’ সরেজমিনে আগুন নির্বাপনে সার্ব্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় (৭ মে) জনকণ্ঠকে একথা বলেন।   

সুন্দরবনে আগুনের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে বন বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিসের সদস্যগণ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আগুন লাগার স্থান ড্রোনের মাধ্যমে আবারও মনিটরিং শুরু করে। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ড্রোনের মাধ্যমে এ মনিটরিং চলে। তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত বনভূমির কোথাও কোন আগুনের আলামত পাওয়া যায়নি। পাশাপাশি বনের অভ্যন্তরে পায়ে হেঁটে একাধিক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেও কোথাও কোনো আগুনের অস্তিত্ব পায়নি। আগুন লাগার স্থানে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফলে পানিতে ভিজে আছে। কোথাও কোথাও পানি জমে রয়েছে। 

সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সুন্দরবনের আমরবুনিয়া ক্যাম্পের আওতাধীন বনাঞ্চলের আগুন নিভে গেছে বলে নিশ্চিত হওয়ায় নির্বাপন কাজের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়েছে।


প্রধান বন সংরক্ষক মো: আমীর হোসাইন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের ৫ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ তবে একই স্থানে বার বার আগুন লাগার বিষয়টি খতিয়ে দেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুন্দরবনের ভরাট নদী-খাল খননে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। 

সংরক্ষিত বনাঞ্চলের উক্ত স্থানে আগুনের ঘটনায় বনজ সম্পদ ও জীব বৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণসহ পরবর্তি করণীয়সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের ৭ সদস্যের পৃথক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে উল্লেখিত বিষয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করবেন।’ তিনি আগুন নির্বাপনে অংশগ্রহনকারী সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। 

বার বার কেন আগুনে পোড়ে সুন্দরবন

বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন দক্ষিণাঞ্চলের রক্ষা কবজ। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগে এ বন বার বার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। প্রকৃতির নিয়মে তা আবার ঠিকও হয়েছে। কিন্তু অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গত দুই যুগে ২৫-২৬ বার পুড়েছে এ বনের বিস্তীর্ণ বনভূমির গাছপালাসহ বিভিন্ন লতা-গুল্ম। জীব বৈচিত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যথেষ্ট।এসব ঘটনায় ২৪টি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বনবিভাগ। 

বন বিভাগের অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। জেলে-মৌয়ালদের ফেলে আসা আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে ১৫ টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আর ৪ বার দাবদাহের এবং ৪ বার মাছ শিকারের জন্য পরিকল্পিত অগ্নিকান্ডের কথা বলা হয়। এছাড়া আক্রোশ বশত অগ্নিসংযোগের সম্ভাবনার উল্লেখ করা হয় ৪ বার। 

বন বিভাগের তথ্যমতে, দুই যুগের এসব অগ্নিকান্ডের সবগুলো ঘটনাই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে ভোলা ওমরা ভোলা নদীসংলগ্ন এলাকায়। ২০০২ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলীও মান্দার বাড়িয়া ২ বার। ২০০৫ সালে পঁচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমুরবুনিয়া, খুড়িয়াবাড়িয়ায়, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার। ২০০৭ সালে পঁচাকোড়ালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়ায় তিনবার। ২০১০ সালেগুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পঁচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় একবার ও ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগরে। 

২০২১ সালের ৩ মে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানি এবং সর্বশেষ চার দিন আগে চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমরবুনিয়া টহল ফাঁড়ির লতিফের ছিলা এলাকায় আগুনের ঘটনা ঘটে।

সুন্দরবনের আগুন‘মানবসৃষ্ট ও পরিকল্পিত’ বলে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সুন্দরবনপ্রেমীরা বারবার দাবী করেন। তারা এ বিষয়ে সরকারকে অধিক গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন(বাপা’র) কেন্দ্রিয় যুগ্ম সম্পাদক সুন্দরবন সংলগ্ন মোংলার মানবাধিকার কর্মী নূর আলম শেখ বলেন, সুন্দরবন সংরক্ষিত বনাঞ্চল হলেও বেষ্ঠনীর নদী-খাল ভরাট হওয়ায় চোরা শিকারীসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। 

গত ২৪ বছরে সুন্দরবনে ২৫-২৬ বার আগুন লেগে দেড় শতাধিক একর বনভূমি পুড়েছে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে-বাওয়ালী বলেন, প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তি ছত্রছায়ায় এবং বন বিভাগের অসাধূ এক শ্রেণির কর্মচারীদের সহায়তায় বনে আগুন ধরিয়ে দেন অসাধু মাছ ব্যবসায়ীরা। পরে বর্ষা মৌসুমে এসব স্থান প্লাবিত হলে নেট বা জাল দিয়ে সহজেই তারা লাখ টাকার মাছশিকার করেন। 

অসাধু এ চক্রেরখুটির জোর এতবেশী যে, সৎ ও দক্ষ বনকর্মকর্তারা অসহায় বা’ ‘কোনঠাসা’ থাকেন। তাদের শায়েস্তা করতে পরিকল্পিত অভিযোগ, এমনকি মামলা পর্যন্ত দিয়ে হয়রানী করা হয়।

 বিশ্লেষকরা বলছেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়া, অসাধু বন কর্মকর্তা-মাছ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম, আইনের ফাঁক-ফোকর, মৌয়ালদের অদক্ষতা, বনসংলগ্ন মানুষের অসচেতনতাসহ বিভিন্নকারণে বার বার সুন্দরবনে আগুন লাগছে ।

মুনাফালোভী মাছব্যবসায়ী ও অসৎ বনকর্মকর্তার যোগসাজশে এবং অদক্ষ মৌয়ালদের কারণে সুন্দরবনে বারে বারে আগুন লাগছে। এর দায়ভার বনবিভাগ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

এ বিষয়ে সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ও সচেতন নাগরিক কমিটি খুলনার সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বন আইনে হওয়া মামলার বিচারিক দীর্ঘ সূত্রিতার কারনে অধিকাংশ সময় দোষীরা পার পেয়ে যায়। তারা পুনরায় একই অপরাধে লিপ্ত হয়। সুন্দরবন বাঁচাতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সমন্বিত উদ্যোগ এবং সব মহলের আন্তরিকতা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরী।

খুলনা অঞ্চলের বনসংরক্ষক মিহির কুমার দো মনে করেন, গত দেড় যুগে সুন্দরবনের সুরক্ষায় বহুমুখী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করায় ‘বন অপরাধীদের’ দৌরাত্ম কমেছে। এ বনের বণ্যপ্রণী ও বনজ সম্পদ রক্ষায় ২০১২ সালে বন অধিদপ্তর, কোস্টগার্ড ও র‌্যাবের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এখন সুন্দরবন অনেকাংশে সুরক্ষিত। যে কোন অপরাধ বন্ধে বনকর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করে দ্রুতগামী জলযান ও ড্রোন-এর মাধ্যমে স্মাট  (SMART-Spatial Monitoring And Reporting Tool) টহল চলছে। সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণের জন্য ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আরও বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।

বার বার আগুন লাগার কারন হিসেবে তিনি মনে করেন, সুন্দরবন লোকালয় সংলগ্ন নদী এবং খাল ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত জোয়ারের পানিতে বনভূমি প্লাবিত না হওয়ায় বিভিন্ন সময় আগুনের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া, মাটির উপর কয়েক ইঞ্চি পুরু জৈব পদার্থ (লতাপাতা ও ডাল-পালা) মজুদ থাকায় গ্রীষ্মকালে নিচের দিকে মিথেন গ্যাস মজুদ হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। আবার লোকালয়সংলগ্ন হওয়ায় অগোচরে কেউ বনে প্রবেশ করে বিড়ি বা সিগারেটের আগুন ফেললে আগুন জ্বলতে পারে। আবার মধু আহরণের মৌসুমে অসচেতন মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া সলতে বা’ মশালথেকে আগুল লাগতে পারে। এছাড়া গরমকালে দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না  হলে শুকনো ডালের ঘর্ষনেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ভবিষ্যতে যাতে আর আগুন না লাগে,সেজন্য ভরাট নদী-খাল খনন করা হবে। তাহলে ওই এলাকাগুলোতে জোয়ারের পানি উঠতে পারবে। এছাড়া বন বিভাগের অগ্নিনির্বাপণ সামগ্রী বৃদ্ধি করা হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। 


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0