আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, সোমবার, মে ২০, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Immortal twenty-one days of inspiration

চিরপ্রেরণার অমর একুশ আজ

Bijoy Bangla

অনলাইন ডেস্ক:

প্রকাশিত: ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০১:১২ এএম

চিরপ্রেরণার অমর একুশ আজ
চিরপ্রেরণার অমর একুশ আজ

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। আজ ‘মাথা নত না করা’র অমর একুশে। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি শুধু প্রাণ বিসর্জন দেয়নি, বাংলার প্রতি ঘরে বুনে দিয়েছিল একুশের রক্তবীজ। সে বীজ থেকেই ভাষাকেন্দ্রিক জাতিরাষ্ট্র। আজকের স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। ২১ ফেব্রুয়ারি তাই আলাদা তাৎপর্যের। সুমহান মর্যাদার। 

প্রতি বছরের মতো আজও রাষ্ট্রীয় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে মহান শহীদ দিবস পালন করা হচ্ছে। অর্ধনমিত রাখা হবে জাতীয় পতাকা। পাশাপাশি কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

একই দিন দুনিয়াজুড়ে পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নিজ নিজ মাতৃভাষার প্রতি সম্মান জানানোর উপলক্ষ হিসেবে দিবসটিকে গ্রহণ করেছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। বাঙালির ভাষা-চেতনা দ্বারা তারাও আজ উদ্বুদ্ধ হবে। নিজ নিজ ভাষার প্রতি যত্নবান হবে।  তবে দেশের প্রেক্ষাপটে বললে, আজ এমন সময়ে অমর একুশে পালন করা হবে যখন বাংলাদেশের মানুষের দেশবোধ, ভাষা চেতনা, ইতিহাসের জ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতিপ্রেম সবই প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে শেকড় বিচ্ছিন্ন তরুণ প্রজন্ম স্থূল চর্চায় এমনভাবে মজে আছে যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রকে সতর্ক করতে, পথ দেখাতেই যেন এসেছে ২১ ফেব্রুয়ারি। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিসত্তার যে স্ফুরণ ঘটেছিল তাই পরবর্তীতে বাঙালি জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মনস্তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক প্রেরণা জুগিয়েছিল। ভাষার অধিকারের পক্ষে লড়াইয়ের পাশাপাশি ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন- শোষণের বিরুদ্ধে একুশ ছিল বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ। নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সংগ্রাম হিসেবেও এর রয়েছে আলাদা তাৎপর্য। এদিন পাকিস্তানিদের সবেচেয়ে ভালো চিনতে পেরেছিল বাঙালি। তাদের সঙ্গে যে থাকা যাবে না- বুঝে গিয়েছিল।  

তারও আগে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় পৃথক দুই রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের দুই অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্বাঞ্চলের মানুষ ছিল মূলত বাঙালি। মাতৃভাষা ছিল বাংলা। অপরদিকে পশ্চিমাঞ্চলে প্রচলিত ছিল সিন্ধী, পশ্তু, বেলুচ, উর্দুসহ আরও কয়েকটি ভাষা।

এ অবস্থায় পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতৃত্ব সমগ্র পাকিস্তানের আনুমানিক পাঁচ শতাংশের ভাষা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত শুরু করে। অথচ তারও অনেক আগে পূর্ব পাকিস্তানে ভাষাচেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। মায়ের ভাষার প্রতি বাঙালির অনুভূতি কত তীব্র ছিল তা জানিয়ে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিম লিখেছিলেন: ‘যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী এই অনুভূতি বুঝাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।

এ অঞ্চলের মানুষকে পেছনে ফেলে রাখার ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রথমে ভাষার ওপর আঘাত হানে তারা। মায়ের ভাষা বাংলা মুখ থেকে কেড়ে নিতে অপতৎপরতা শুরু করে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সকল অনুভূতি তুচ্ছ করে উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসতে থাকে পাকিস্তানের শীর্ষ মহল থেকে। এমন ষড়যন্ত্রে হতবাক হয়ে যায় বাংলার মানুষ। বাঙালির সে সময়ের মনোজগৎ তুলে ধরে কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে।/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা,/তাই কি হয়?’ 

এর পরও নিজেদের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। গণচেতনাকে স্তব্ধ করার ভয়ংকর পথ বেছে নেয়। এ অবস্থায় বাঙালির সামনে দুর্বার আন্দোলনের বিকল্প ছিল না। ১৯৪৮ সাল এবং ১৯৫২ সালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম তার প্রমাণ। 

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিদের গোঁয়ার্তুমির চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে। এদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ। কিন্তু সকল ভয় জয় করে ছাত্ররা রাজপথে নেমে আসে। ভাষার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পুলিশ। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা আরও অনেকে। গীতিকবির ভাষায়: ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলিরে বাঙালী/তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।’

মায়ের ভাষার জন্য ঢাকার রাস্তায় বিরল রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছিল সেদিন। ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসে। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের স্মরণে গড়ে তোলা হয় স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ। তবে তাতেও কোনো কাজ হয় না।

‘কোথায় বরকত কোথায় সালাম/সারা বাংলা কাঁদিয়া মরে।/যে রক্তের বানে ইতিহাস হলো লাল/যে মৃত্যুর গানে জীবন জাগে বিশাল/সে জাগে ঘরে ঘরে।’ বাংলার ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় ষড়যন্ত্রকারীরা। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি লাভ করেছে অমর একুশে।

প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ॥ একুশের প্রথম প্রহর থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো শুরু হয়েছে। রাত ১২টা ১ মিনিটে রাষ্ট্রের পক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দীন ও সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। পর্যায়ক্রমে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তিন বাহিনীর প্রধান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।

বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকেও শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হয়। ক্রমে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সাধারণ মানুষের ঢল নামে। শহীদ মিনার ঘিরে বিভিন্ন বয়সী মানুষের দীর্ঘ সারি লক্ষ্য করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, পলাশী মোড় ছাড়িয়ে নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজে গিয়ে ঠেকে অপেক্ষারতদের সারি। বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে আসা মানুষের হাতে ছিল তাজা ফুল। অনেকে সন্তানকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। খুব সুন্দর ছিল এ দৃশ্যটা।   

সকাল বেলায়ও বহু মানুষ প্রভাতফেরিতে অংশ নেবেন। ‘প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/আমায় নেবে সঙ্গে,/বাংলা আমার বচন, আমি/জন্মেছি এই বঙ্গে।’ বঙ্গ-সন্তানরা ঢাকার পাশাপাশি গোটা দেশের প্রতি প্রান্তে, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে থাকা শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে।  

রাজধানীজুড়ে একুশের অনুষ্ঠানমালা ॥ বরাবরের মতো এবারও কয়েকদিন আগে থেকে রাজধানীতে শুরু হয়ে গিয়েছিল অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ঢাকার একাধিক মঞ্চ থেকে দিবসটি পালন শুরু করে। সে ধারাবাহিকতায় আজ রায়ের বাজার শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে থাকবে সংগীত নৃত্য কবিতাসহ বহুবিধ পরিবেশনা। 

শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলছে একুশের সাংস্কৃতিক উৎসব।

আট দিনব্যাপী উৎসবের সপ্তম দিনে আজ অভিন্ন আয়োজন থাকবে সেখানে। উদীচীও একদিন আগে প্রেস ক্লাব এলাকায় নিজস্ব কার্যালয়ের সামনে একুশের অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে। অনুষ্ঠান থেকে সংগীত কবিতা ও নৃত্যায়োজনে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।

আজ ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক দিনে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করবে ছায়ানট। সন্ধ্যায় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব মিলনায়তনে থাকবে অমর একুশের স্মৃতিকথা, একক ও সম্মেলক সংগীত। 

তারও আগে ভাষার মাসের প্রথম দিন থেকে রাজধানীতে চলছে অমর একুশে বইমেলা। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন বইয়ের বিপুল উপস্থাপনা। সেইসঙ্গে মেলার মূল মঞ্চে আজ ভাষা সংগ্রামের ওপর বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় জাদুঘরে সকালে আয়োজন করা হবে ‘বঙ্গবন্ধু, রাষ্ট্রভাষা ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার ও আলোচনা সভা। 

এভাবে দিনভর চলবে নানা আয়োজন। সমস্ত আয়োজনের মধ্য দিয়ে একুশের চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এগিয়ে নেওয়ার শপথ নেবে বাঙালি। কবির ভাষায়: ‘স্বাধীন এই বাংলা আমার/কোটি প্রাণ শহীদ মিনার/নেবই নেব, নেবই নেব/নেবই নেব আমরা মনের মতো এই দেশ গড়ে...।’ দেশ গড়ার এই শপথে নতুন করে আজ জেগে উঠুক বাঙালি। বলার অপেক্ষা রাখে না, তবেই সার্থক হবে একুশের  আনুষ্ঠানিকতা।

বিবিএন/২১ ফেব্রুয়ারি/এসডি


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0