দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর, গত ১০-জানুয়ারি (বুধবার) শপথ গ্রহণ করেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ। সংবিধানের বিধান অনুযায়ী, গেজেট প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে হয়। শপথ গ্রহণের পরই তিনি কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হয়। সে নিয়ম অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করেছেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে মন্ত্রিপরিষদ, সিন্ডিকেটে সদস্য, উপ-কমিটি নানান রাজনৈতিক পদ-পদবি নামের আগে লাগাতে দারুণ ব্যস্ত সময় পার করতে দেখেছি নেতাদের। এ সকল পদ-পদবী পাওয়ার আশায় ঢাকায় কম জুতা ক্ষয় করেনি নেতারা। বলায় যায় পদ-পদবি পাওয়া এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতার অংশ।
প্রথমে এমপি-মন্ত্রীদের চাওয়া পাওয়ার তালিকা ছিল ছোট। চাওয়া-পাওয়া ছিল শুধু " জনগণের সেবা করবে যতদিন তাঁরা বেঁচে থাকবে, জনগণকে সেবা দেওয়ার লক্ষ্যেই তারা ভোটে নেমেছে" এমনটি শুনে এসেছি নির্বাচনের আগে।সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর চাওয়া-পাওয়ার তালিকা যে বেড়েছে- তাতে সুবিধাভোগী ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে দাবি করা অনেক নেতার মুখে যখন "আলহামদুলিল্লাহ" শুনি । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো যখন নেতার গুণগান গেয়ে গরম করতে দেখি। তখন বুঝি যাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে, পকেট ভর্তি কালো টাকা' র উপায় মিলেছে তারা মহাখুশিতে নেতার কথা বিভিন্ন ভাবে প্রচার করে, প্রচারের সাথে-সাথে এও জানান দেয় আমরা হাওয়া বদল করেছি,আমরা কুৎসিত প্রতিবন্ধী বড়লোকের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছি। আর এদিকে যারা আশাহত হয় তারা মুখে-মুখে বলে "বহিরাগতদের ভিড়ে ত্যাগীদের মূল্যায়ন হচ্ছে না, আমরা মরতে বসেছি" বিভিন্ন ভাবে নেতাকে বুঝাতে চাই তারা ভালো নেই, তাদের আশার দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সত্যিই তাই নেতা এখন অনেকখানি মাতাল অবস্থায় দিন শেষ করছে। পূর্বের বক্তব্য, কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশের ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা রূপ নিয়েছে। যে নেতা কিছুদিন আগে মাঠে ছিল ঘর্মাক্ত অবস্থায়, চেহারার দিকে তাকালে মনে হতো নিজের পকেটের সৎ ইনকামের যেটুকু অর্থ আছে সেগুলো চিন্তা না করে দিয়ে দেই। কিন্তু এখন এ কি অবস্থা!
গ্রামের বাড়ি ভাঙ্গা, সিলিং ফ্যান নেই, গরম নিবারণের যথেষ্ট সুযোগ নেই, এলিট খাবারের আয়োজন নেই, আইরণযুক্ত পানি, কাঠ বিস্কুট খেয়ে উচ্চ কণ্ঠে বলে যেত "আমি তোমাদের লোক, সব সময় পাশে আছি"। কিন্তু এখন নেতা গ্রামে আসলে এলিট পরিবার কোনটি, কার বাসায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা আছে, ফলের টাটকা জুস আছে সেদিকে নজর দেয়। অবশ্য এটি আমি সাপোর্ট করি কেননা সে এত গুলো মানুষের প্রতিনিধি, নেতার যদি পুষ্টি চাহিদা না মিটে, লেবাস যদি রিফ্লেক্ট না করে, গাড়িতে যদি সাক না বাজে, সামনে - পিছনে প্রশাসনের অস্ত্রের ঝনঝন শব্দের সাথে মুখের তিতা কথা অসহায় মানুষের শরীরে লেপটে না যায় , তাহলে এমপি-মন্ত্রী ভাবটা আসেনা ? মানুষ নেতা মানতে রাজি হয় না।
অথচ কয়েকদিন আগে কৃষক, মেহনতিরা আশায় বুক বেঁধেছিল, সারাদিন মাঠে পরিশ্রম শেষে চায়ের কাপে তুমুল ঝড় তুলেছিল, গর্ব করে বলত- জানিস নেতা আমার ঘামের দুর্গন্ধ উপেক্ষা করে আমাকে বুকে নিয়েছিল,আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, এতো ভালো মানুষ এর আগে দেখিনি, ভোট তাকেই দিতে হবে। কি দারুণ সত্য প্রকাশ ! বিষয়টি নিজ চর্মচক্ষে না দেখলে বুঝতে পারা শক্ত, একজন কৃষক কত অহংকার নিয়ে তার নেতার জন্য ভোট চেয়েছিল, আশা করেছিল।
কিন্তু এমপি মন্ত্রী হওয়ার পর নেতাদের দেখা পাওয়া " ডুমুরের ফুল কিংবা সাপের পা দেখার মত অসম্ভব শক্ত কাজ" । নেতারা এখন থাকে ঢাকায়, কিছুদিন পর-পর জানাজায় দেখা মিলে, খেলা উদ্বোধন করেন, মসজিদে ইমামের দ্বায়িত্ব পালন করেন, জম্মদিন পালন করেন, বিয়ের দাওয়াতে আসেন লম্বা-লম্বা বক্তৃতা দিয়ে চলে যান। আর যারা এই সকল আয়োজন করতে ব্যর্থ হয় তারা দূর থেকে কষ্ট চেপে রেখে নেতার যাতে ঘুম ভাঙ্গে কর্মীকে যাতে যথাযথ মূল্যায়ন করে সে দিন গুনে। মনে-মনে নেতার ভালো চাই কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তবে পতন যে চাই সেটি হলফ করে বলাই যায়। সত্যি বলতে তাদের খোঁজ কেউ রাখে না, এমপি-মন্ত্রী তো রাখেই না। রাখার কথাও না কারণ তারা এখন অনেক ব্যস্ত, তাদের নামের আগে এমপি-মন্ত্রী আছে।
অথচ একজন জনপ্রতিনিধির কি শুধু ঐ কাজগুলোর মধ্যেই থাকার কথা ছিল ? নাকি রাস্তা- ঘাট, সুবিধা -অসুবিধা, রোদে পোড়া গামছার আড়ালে কালো মুখগুলোর খোঁজ নেওয়া, দ্বারে-দ্বারে গিয়ে সুখ- দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার কথা ছিল ? এমপি মন্ত্রী এখন বলে দেশে পদ্মা সেতু হয়েছে, মেট্রোরেল হয়েছে উন্নতি আর উন্নতি, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর দেশের উন্নতি হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি কি করছেন ? আপনার এলাকায় কি উন্নয়ন করলেন ? নাকি সান্ত্বনা দেবেন এই বলে যে - নতুন এমপি-মন্ত্রী আমরা দায়িত্ব বুঝে পায় নাই, করছি -করব এই পর্যন্তই। কিছুই বুঝে উঠেননি তাহলে নিজের লেবাস, গাড়ি, চলাফেরা, মাঝামাঝি কথা, টাকা-পয়সা সমন্বয় করা এগুলো কবে বুঝে পেলেন ? নিজের চাহিদা গুলো ঠিক বুঝে নিলেন, জনগণের গুলো বুঝে পেলেন না আফসোস!
দেশ অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে, অনেক উন্নয়ন হয়েছে স্বীকার করছি। কিন্তু দ্রব্য মূল্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে, যাদের ভোট নিয়ে সংসদে গিয়েছেন, তাদের কথা, বর্তমান অবস্থা কি সংসদে বলছেন ? প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জনগণের কথার বাইরে কোনো কথা বলবেন না। কিন্তু পাঁচ মিনিট কথা বলার সুযোগ পেলে নিজের গদি টিকিয়ে রাখার জন্য ৪ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড তৈল মর্দন করেন, বাকি দুই সেকেন্ড জনগণের কথা শুরু করতে গিয়ে মাইক বন্ধ হলে বসে পড়েন। জনগণ কি শুধু ২ সেকেন্ড আশা করে আপনার থেকে ? আবার ভেতরে-ভেতরে খুব খুশি হন এই ভেবে যে- বিশাল কথা বলেছেন, জনগণ টিভির ওপাশ থেকে হাত তালি দিয়েছে। আসলে সেটি নয়, তারা টিভি বন্ধ করে ভেতরে কষ্ট নিয়ে বসে পড়ে।
সাহস করে বলেন একদিন জনগণের কথা, বলেন মানুষ ভালো নেই, বলেন এলাকায় রাস্তা লাগবে, কর্মসংস্থান লাগবে, বিদ্যুৎ- গ্যাসের দাম কমাতে হবে, মজুরি বাড়াতে হবে। গদি হারাবার ভয় না করে সত্য একদিন বলেন , দেখবেন আপনার জন্য জনগণ চোখের পানি দিয়ে গোসলের আয়োজন করবে, সুইমিং পুল, গিজারের পানি ফেল করবে মানুষের ভালোবাসার কাছে। ধর্ম পরিবর্তন করুণ কিন্তু সেটি যেন জনগণের ধর্ম হয়, জনগণের ধর্মই যেন আপনার ধর্ম হয়।