আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, সোমবার, মে ২০, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

ACC intervention sought

সম্পদের পাহাড় ঢাকতে হলফনামায় তথ্য গোপন

Bijoy Bangla

সৈকত সোবাহান, বদলগাছী, নওগাঁ

প্রকাশিত: ২১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ০২:৫০ পিএম

ঠিকাদারী সিন্ডিকেট, খাস পুকুর ও জমি দখল, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-কমিটি বাণিজ্য, কমিশন আদায়, আত্রাই নদীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রণসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে নৌকা থেকে ছিটকে পড়া নওগাঁ৩ (মহাদেবপুর-বদলগাছী) আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিমের বিরুদ্ধে। তার এসব অপকর্মের মূল হাতিয়ার তার ছেলে ও ভাগ্নে। মহাদেবপুর, আজিপুর, নওহাটা, নওগাঁ সদর, ঢাকাসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে তারা গড়ে তুলেছেন বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড়। এসব সম্পদের মূল্য আনুমানিক প্রায় কয়েক’শ কোটি টাকা। এমন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিব্রত। আর সম্পদের পাহাড় ঢাকতে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় তথ্য গোপনেরও অভিযোগ উঠেছে বিতর্কিত এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা।


স্থানীয় আ.লীগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নৌকার প্রার্থী সাবেক এমপি প্রয়াত ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে তার অস্বাভাবিক উত্থান। পরে অবশ্য ২০১৮ সালে আ.লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি মহাদেবপুর উপজেলা আ.লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করছেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তার ছেলে রকি ও ভাগিনা শাকিলের বাহিনী এলাকায় শুরু করে দখলদারিত্ব। নামে-বেনামে শত শত বিঘা খাস পুকুর রয়েছে তাদের দখলে। রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এসব পুকুরে মাছ চাষ করছে তাদের লোকজন। প্রভাব খাটিয়ে অধিকাংশ স্কুল ভবন নির্মাণ-সংস্কার, রাস্তা-ঘাট, ড্রেন, বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমের ঠিকাদারী কাজ তারাই করে থাকেন। এসব কাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে থাকে নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করেই। এ নিয়ে ভয়ে কথা বলার সাহস করে না কেউই। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম আ.লীগের মনোনয়ন না পাওয়ায় এলাকায় চলছে আনন্দ-উল্লাস। স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন তিনি। তবে পূর্বের নানা অপকর্ম ও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারির কারণে ভোটের মাঠে জনরোষের শিকার হচ্ছেন ছলিম উদ্দীন তরফদার। এখানে এবার দলের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সবেক সিনিয়র সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী।


নির্বাচনী হলফনামা যা বলছে : ছলিম উদ্দীন তরফদার এখন বছরে আয় করছেন ৬ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালে তার বার্ষিক আয় ছিল ৪ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। দুই মেয়াদে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব পালনের পর তার আয় বেড়ে ১৪০ গুণ হয়েছে। আয় বাড়ার পাশাপাশি এই সংসদ সদস্যের সম্পদও বেড়েছে। ১০ বছরে স্থাবর সম্পদ বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৮ গুণ এবং অস্থাবর সম্পদ বেড়ে সাড়ে ৬ গুণ হয়েছে। দ্বাদশ ও দশম সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা তার হলফনামা বিশ্লেষণ করে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

 লাগামহীন সম্পদের মালিক : ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পর নওগাঁ শহরের গোস্তহাটির মোড়ে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ব্যায়ে ৩১ শতক জায়গার উপর একটি ১২তলা টাইম স্কয়ার নামে বানিজ্যিক ও আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। মহাদেবপুর সদরের কলেজ রোডে এক কোটির অধিক টাকা দিয়ে ৩ তলা বাড়ি কিনেছেন। বর্তমানে এটি ৫ তলা ভবন। যা নক্ষত্র বাড়ি নামেই পরিচিত। গ্রামের বাড়িতে রয়েছে বিশাল গরুর খামার ও একটি ইটভাটা, মহাদেবপুর সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে পাওয়া সূত্রে ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের সেপ্টম্বর পর্যন্ত এমপি সেলিম ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ৮২টি জমি ক্রয় করার দলিল পাওয়া যায়। সেসব দলিলের মূল্য প্রায় ৮ কোটি ৫২ লাখ ১৭হাজার টাকা। রয়েছে কয়েকটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান, ২টি কম্পানী, অসংখ্য গাড়ি, নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক একাউন্টে রয়েছে কোটি কোটি টাকা।


যত অভিযোগ এমপি সেলিম, তার ছেলে ও ভাগিনার বিরুদ্ধে:  অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাদেবপুর সদর, উত্তরগ্রাম, ভীমপুর এবং এনায়েতপুর ইউনিয়ন এর বিএনপির ১৫ জন নেতা-কর্মীকে আ.লীগ ও সহযোগি সংগঠনের নানা পদে যুক্ত করেছেন। মহাদেবপুর থানা বিএনপির তালিকা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। সম্প্রতি বদলগাছী কোলা আদর্শ ডিগ্রী কলেজে তিনজন প্রভাষক ও একজন ল্যাব সহাকারী পদে মোট ৮৮লাখ টাকা নিয়োগ বাণিজ্যর অভিযোগ উঠেছে। এই টাকাগুলো এমপি সেলিম তার নিজের পকেটে ঢুকিয়েছেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ধৈনজল চেরাগপুর ইউনিয়ন সমবায় সমিতির ১৫শতাংশ জায়গা দখল, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে মাইমা দিঘীর ৪২ বিঘা জমি দখল এবং তার পাশেই অবস্থিত আদিবাসী পাড়ার ২৫বিঘা জমি দখল করে পুকুর খনন, আলতাদিঘী, রাইগাঁ ইউনিয়ন এর কৃষ্ণপুর মৌজায় ৪২বিঘা জমি দখলের অভিযোগ করা হয়েছে চিঠিতে। এসব ঘটনার পর এমপি সেলিমের বিরুদ্ধে ১৫ জন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কাজী নুরুজ্জামান বেলালসহ বেশ কয়েকজন বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, ইউপি নির্বাচনে মনোনয়ন বানিজ্য, দলীয় পদে নিয়োগ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতি করে যাচ্ছেন বর্তমান এমপি। নামে বেনামে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি। ত্যাগী নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করে নিজের পছন্দমত কমিটি করে বিভিন্ন পদে বিএনপি জামায়াত সমর্থিত নেতা-কর্মীদের স্থান দিয়েছেন। নিয়োগ বাণিজ্য, জমি, খাস পুকুর দখলসহ বেশ কিছু অভিযোগ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবার দেওয়া হয়েছে। আমরা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি।

মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা অধ্যক্ষ ময়নুল ইসলাম বলেন, সফাপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ২০১৬ সাল এবং ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলাম। এমপি সেলিম তার পছন্দের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে আমাকে হারিয়ে দেয়। দলীয় নীতি আদর্শের তোয়াক্কা করেননা তিনি। আমাকে উপজেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নাকি করা হয়েছে। দুই বার চিঠি দিয়েছিল। তার পর আর কোন চিঠি দেইনি। তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটিই প্রকাশ করেনি। আপনারা যা তথ্য পেয়েছেন তার চেয়ে অধিক সম্পদের মালিক তিনি। দুই উপজেলার শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ হয়, এসব নিয়োগের টাকা তার পকেটে যায়। শুধু এলাকাতে নয় দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি দেশের বাহিরেও তার সম্পদ আছে। আমাদের জানা মতে তার ৮টি গাড়িও আছে। স্থানীয় ইউপি নির্বাচনে বিপুল অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন দেওয়া, দলীয় পদ দিয়ে অর্থ আদায়, কিছু নেতা-কর্মীদের ব্যবহার করে খাস জমি ও পুকুর দখল করে রেখেছেন তিনি।


অভিযোগগুলো অস্বীকার করে এমপি ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ এর বিষয়গুলো থাকে কমিটির ওপর। প্রধানমন্ত্রীর কাছে যে কেউ অভিযোগ দিতেই পারেন কিন্তু সেগুলো কতটা সত্য সেটাই বড় বিষয়। যদি অপরাধ করে থাকি তাহলে ব্যবস্থা হবে। রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রাপ্ত দলিলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো সঠিক নয়, কোটি টাকার সম্পদের দলিল তো দূরের কথা কোটি টাকাও আমার নেই। আর নওগাঁ শহরের যে বাসা আছে সেটা ৩১শতক; যেটা ১৯৮৯সালে ক্রয় করা। লোনের মাধ্যমে করা। এখনও কিছু টাকা ব্যাংক লোন পরিশোধ করা বাঁকি আছে। তিনি আরও বলেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় সবাই নির্বিঘ্নে ঠিকাদারি করে থাকে। আর আমার ছেলে আর ভাগিনাও ঠিকাদারি ব্যবসার সাথে জড়িত তাই তারাও ছোটখাটো কিছু কাজ করে। সব অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কিছু বিপদগামী কথিত আওয়ামী লীগ নেতারা এসব মিথ্যা ছড়াচ্ছে বলে দাবি তার। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা হলফনামায় সম্পদের পাহাড় ঢাকতে তথ্য গোপনের বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি এই সংসদ সদস্য।

google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0