আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Veer Vikram

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ১০:০৪ এএম

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম

শহিদ আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম ছিলেন নামকরা ক্রিকেটার। শিক্ষা জীবনেও ছিলেন মেধবী। দেশের স্বাধীনতার জন্য ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নেন, স্টেনগান, গ্রেনেড এক্সপ্লোসিভ। মা ফিরোজা বেগম, বাবা আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী। থাকতেন ঢাকার কে.এম দাশ লেনের টিকাটুলিতে।

জুয়েল দেশের পরিস্থিতিতে নিয়ে ভীষণ চিন্তা করতেন ভাবতেন। ১ মার্চ ঢাকা স্টেডিয়ামে বন্ধু আজাদ (শহিদ) ও অন্যান্যদের নিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণায় গ্যালারী থেকে সকলের সাথে প্রতিবাদী শ্লোগান দিতে থাকেন। প্রতিবাদী মিছিলে অংশ নেন। ৭ মার্চ ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের গণহত্যা বাড়ি থেকে প্রত্যক্ষ করেন। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল হলে বন্ধু আব্দুল মতিন চৌধুরী (অব: মেজর) কে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পড়ে থাকা অসংখ্য মৃতদেহ দেখে সৈয়দ আশরাফুল হক, জিয়াউদ্দিন আহমদকে নিয়ে কøাব পাড়ার লোকজনের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে দেখলেন ঢাকা জেলা স্পোর্টস এসোেিসয়শনের মিলনায়তনের হলরুমের তাল কøাবের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মোশতাক আহমেদের মৃতদেহ। তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। বন্ধুদে সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতে থাকলেন। সেনাবাহিনীর, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীর বাঙালিদের বিদ্রোহ তাকে শক্তি জোগায়। বাড়ির পিছনে মসজিদে নিয়ে আসা অসংখ্য মৃতদেহ তাকে বিেেদ্রাহী করে তুলে। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মা তাকে বলে “তুই গেলে কাকে দেখবো”। জুয়েল একটি ছবি বাঁধাই করে নিয়ে এসে বলেন, “যখন থাকবোনা, তখন এটি দেখো”। মা বাঁধা দেন নি। তাঁর বন্ধু বান্ধব ফুফাতো ছয় ভাই সহ জানাশুনা অনেকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

জুয়েল প্রথমে আগরতলার মতিন নগরে যান, এরপর মেলাঘর ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন এটি.এম হাইদারের কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধ ফতে আলীর তথ্যে জানা যায়, একদিন তারা একটি খাবার হোটেলে ঢুকলে, হোটেলের মালিক জিজ্ঞাসা করেন, “ আপনারা কি মোহমেডান”। জুয়েল উত্তরে আজাদ বয়েজ কøাব। মালিকটি বুঝে ফেলে খাবার দিতে রাজী না হলেও শরণার্থীদের চাপে খাবার দিতে রাজী হয়। ট্রেনিং শেষে জুয়েল ঢাকায় এসে সন্ধ্যায় বাড়িতে গেলে তাকে চিনতে না পেরে , আলু ভাজি করতে থাকা বোন রেশমি ভয় পেলে তিনি পরিচয় দিয়ে চুপ থাকতে বলেন। বোন রেশমি স্মার্ট ভাই জুয়েলের পরিবর্তন অবাক দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন। জুয়েলের সাথে স্টেনগান, ব্যাগে গ্রেনেড এক্সক্লোসিভ। সেই পাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধা। তার আবদারে মা তাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের সেল্টার  ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে বারো পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হলে, জুয়েল নিরাপত্তার জন্য বোনদের নানী বাড়ি পাঠিয়ে দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসিবুল আলম বীরপ্রতীকের তথ্যে জানা যায়। ট্রেনিং এর সময় জুয়েল খেলার মতোই সব কিছু শিখে ফেলেন। জুয়েল সঙ্গীদের নিয়ে অ্যকশন অপারেশন করে ঢাকাকে তোলপাড় করে দেয়। ফুফাতো ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা রইছ উদ্দীন পুটু তাকে তথ্য সংগ্রহ, রেকি দায়িত্ব দিলে জুয়েল সঠিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্ব পালন করে।

২২ জুলাই ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে তেলের ট্যাঙ্কার শ্যামপুর রেললাইন ধ্বংশ করে দেয়া হয়। জুয়েল  তরুণ যুবকদেও ট্রেনিং এর ব্যবস্থা আহতদের সেবা লিফলেট তৈরিতেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। এই গ্রুপের সাথে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশারফের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াসিফ ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তিন বাঙালি মেজরকে বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদ সাদিক চুনুর গাড়িতে মেঘনা ঘাটে পৌছে দেন। ১৮ জুলাই ঢাকার গুলিস্থানের গ্রানিজ ও ভোগ বিপণী কেন্দ্রে মোটরবাইকে করে অপারেশন করতে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা মায়া, সানু, গোলাম দোস্তগীর, গাজীকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সামাদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা উলফাতকে নিয়ে গাড়িতে কভারিং সাপোর্ট দেন। ১৯ জুলাই ঢাকা এলিফ্যান্ট রোডের পাওয়ার হাউজ, মালিবাগ, রামপুরা,মতিঝিল, তেজগাঁও পাওয়ার হাউজ ও গর্ভণর হাউজের পাশের পাওয়ার হাউজে অপারেশন করলে ঢাকা অন্ধকারছন্ন হয়ে যায়। ১৫ আগষ্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজ অপারেশনে আসার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা বদির নৌকা পাকিস্তানি সৈন্যদের টার্গেটে পড়ে গেলে, বদির অ্যাকশন থেকে শুরু হয়ে গেল বড় অ্যাকশন। কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও নদীতে  লাফ দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সফল অপারেশনের পর আহত জুয়েলকে পিরুলিয়া ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে পরের দিন বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বদি ঢাকায় নিয়ে আসলে খবর পেয়ে ডাক্তার সাজ্জাদুল আলম নিজে তাদের অবস্থান স্থলে গিয়ে চিকিৎসা সেবা দেন। ডাক্তার রশীদ উদ্দীন আহমেদ কাজী কামালের বাড়িতে জুয়েলের চিকিৎসা করার পর তাকে ডাক্তার মতিন উদ্দীনকে দেখিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের ডাক্তার আজিজুর রহমানের কাছে নিয়ে গেলে তিনি ও তার স্ত্রী ডাক্তার সুলতানা বেগম চিকিৎসা দেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল ও কাজী কামালকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এটি ছিল গেরিলাদের সেল্টার ও অস্ত্র ভাণ্ডার। বাড়ির সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। হাবিবুল আলমের বাবার গাড়ি ট্রায়াল্ফহেরান্ড গেরিলারা মাঝে মধ্যে ব্যবহার করতেন। হাবিবুর আলমের বোন আসমা, রেশমা, শাহনাজ জুয়েলের সেবার দায়িত্ব নেন।

২৮ আগষ্ট জুয়েল মায়ের সাথে দেখা করার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদদের মালিবাগের বাড়িতে গিয়ে দেখা পান বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল, বীর মুক্তিযোদ্ধা হ্যারিশ, আজাদের স্বজন ও অন্যান্যদের। আজাদের মা সকলের জন্য ভালো রান্না করেন। ৩০ আগষ্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা দিবাগত রাত ১.৩০ মিনিটে বাড়িটি ঘিরে ফেললে নামাজের জন্য জেগে থাকা আজাদের মা অস্ত্র সরাতে থাকেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা আজাদের ঘরে ধরা পরা পুরুষদের লাইন করিয়ে আজাদকে নির্যাতন করতে থাকে। জুয়েলের হাতে ব্যান্ডেজ দেখে নানা জেরা করে নির্যাতন করলে তার হাত রক্তাত্ব হয়ে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী  কামাল পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে জয়েল ও আজাদকে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। আজাদের স্বজন জায়েদ ও টগর গুলিবিদ্ধ হন। জানা যায় এই অ্যাকশনে পাকিস্তানি এক সৈন্য নিহত হয়। কাজী কামাল সেখান থেকে বেরিয়ে হাসিবুলের বাড়িতে গিয়ে লুঙ্গি নেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা জুয়েল, আজাদ, বাশার, সেকেন্দার হায়াত খান, মনোয়ারকে ধরে নিয়ে গেল। ৩১ আগষ্ট জুয়েলের বাবা ওয়াজেদ আলী রমনা থানায় তার সাথে দেখা করেন। ১ সেপ্টেম্বর মা ফিরোজা বেগম সেখানে গিয়ে তার সাথে দেখা করেন।  সেপ্টম্বর বোন সুরাইয়া দেখা করতে গিয়ে তাকে পান নি। বিজয় হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল ফিরে আসনেনি। বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্রিকেটার শহিদ আব্দুল আলিম চৌধুরী জুয়েলকে বীর বিক্রম খেতাব দেন। ঢাকা মীরপুর শেরে বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়ামের একটি গ্যালারির নাম তার নামে এবং আরেকটি গ্যালারির নাম আজাদ বয়েজ ক্লাবের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শহিদ মোস্তাক আহমেদেরে নামে নামকরণ করা হয়েছে। শহীদ জুয়েল অনেক সম্মামনা পেয়েছেন। কিন্তু এইসব বীর শহিদদের অবদান আমরা ভুলে যাচ্ছি। প্রজন্মদের তাদের কথা জানাতে তেমন উদ্যোগ নেই, এ দায়িত্ব কার? তথ্যসূত্র: ক্রিকেট অঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে-রুবিনা হোসেন।

গ্রন্থনা- মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক রাজশাহী ০১৯১১৮৯৪২৬০


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0