আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Blood speaks

স্বাধীনতার নাটকঃ রক্ত কথা বলে

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশিত: ২৬ মার্চ, ২০২৪, ০৯:৩৩ এএম

স্বাধীনতার নাটকঃ রক্ত কথা বলে
স্বাধীনতার নাটকঃ রক্ত কথা বলে

তখন চলছিল অসহযোগ আন্দোলন। রাজশাহী জেলা সদরের শিল্পীরা নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করলেও তখন তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে নিজস্ব কোনো কর্মসূচি ছিল না।রাজশাহী জেলা সদরের রানী বাজার বাটার মোড়ে (জয় বাংলা চত্বর) নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন আহমেদের ঘড়ি-চশমার দোকান 'ঘড়ি ঘরে' সময় কাটাতেন নাট্যব্যক্তিত্ব অনিল বন্ধু রায় (লাডু বাবু), শেখ আতাউর রহমান, মোম্রফিজুর রহমান গামা, আব্দুর রশিদ, সাংবাদিক আবু সাঈদ (মুক্তিযুদ্ধে শহিদ), আনোয়ারুল ইসলাম, ওস্তাদ আব্দুল জাব্বার, ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুসহ অনেকে। শিল্পীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজস্ব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত ভেবে তৎকালীন পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল রাজশাহীর সর্বকনিষ্ঠ সম্পাদক আব্দুর রশিদ প্রস্তাব করলে ১০ মার্চ শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করার পর  ১১ মার্চ সকালে রাজশাহী জেলা সদরের ঘোড়ামারা পাড়ায় পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিলে এক সভায় মোস্তাফিজুর রহমান গামাকে আহবায়ক ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু ও আব্দুর রশিদকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে অনিল বন্ধু রায়, শেখ আতাউর রহমান, আনোয়ারুল ইসলাম, ওস্তাদ আব্দুল জাব্বার ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সদস্য করে শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। সকলকে উজ্জীবিত করতে, শিল্পীরা কখনো ট্রাকে কখনো হেঁটে গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে গাইতে থাকেন গান গণসঙ্গীত। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা চলতে থাকে পরিষদের কর্মসূচির পাশাপাশি অন্যান্যদের কর্মসূচির সঙ্গে একত্মতা ঘোষণা। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ব্যবসায়ী আলতাব হোসেন (শহিদ) শিল্পীদের অনুষ্ঠান করার জন্য তার ট্রাকটি দিলেন । 

ঝুঁকি-বাধা উপেক্ষা করে গণসঙ্গীতে অংশ নেন ওস্তাদ আব্দুল জাব্বার, ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু, শেখ আব্দুল আলিম, নাসির উদ্দিন, এ এইচ এম রফিক হাবলু, রবিউল হোসেন, সারো ওয়ার জাহান, রেজওয়ানুল হক রমা, হাবিবুর রহমান লাবু, আব্দুল খালেক ছানা, কানু মোহন গোস্বামী, নুর হামিম রিজভী (বীরপ্রতীক), ইফাত আরা নার্গিস, কাজী বাচ্চু, মিনা রব, অ্যান্ড্রু কিশোর, স্মৃতি কণা মজুমদার, নুরুন নাহার লাভলী, নিলুফার জাহান, কনিষ্ঠ শিল্পী অনুপ কুমার দাশ সহ অন্য শিল্পীরা। সিদ্ধান্ত হল ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর রাজশাহী জেলা সদরের ভুবন মোহন পার্কে নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে । সে সময় নাটকের মহড়া দেওয়ার জন্য কেউ জায়গা দিতে রাজি না হলেও রানী বাজার এলাকায় লোকনাথ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ময়েজ স্যারের বাড়িতে জায়গা পাওয়া গেল। এ ব্যাপারে বিশেষ সহযোগিতায় ভূমিকা রাখেন ময়েজ স্যারের ছেলে ইউসুফ আজাদ। তীক্ষ্ণ দূরদর্শিতা দিয়ে চলচিত্র পরিচালক, নাট্যব্যক্তিত্ব শেখ আতাউর রহমান লিখলেন নাটক 'রক্ত কথা বলে' । 

নাটক লেখার সঙ্গেই চরিত্র নির্বাচন ও মহড়া চলতে থাকে। নারী চরিত্রে কোন নারীকে না পাওয়া যাওয়ায় শেখ আতাউর রহমান, জাফর ইমাম, হাসানুজ্জামান খোকা, রাজশাহী কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্ম রত নাট্যব্যাক্তিত্ব বদিউল আলম ভুলু, পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল রাজশাহীর সর্বকনিষ্ঠ সম্পাদক আব্দুর রশিদ নাটোরে গিয়ে নাট্যশিল্পী অর্পনা ও পুতুলের সাথে যোগাযোগ করলে তারা রাজি হলেন। নাটকটি যাতে মঞ্চস্থ না হতে পারে সেজন্য চলতে থাকে ষড়যন্ত্র। ঝুঁকি উপেক্ষা করে দেশপ্রেম ও সাহসের জোরে সবরকম প্রস্তুতি চলে। ২৪ মার্চ নির্দিষ্ট সময়ে অর্পনা ও পুতুল না আসায় আব্দুর রশিদ ও বদিউল আলম ভুলু নাটোরে গিয়ে জানতে পারেন অর্পনা ও পুতুল কে রাজশাহীতে না আসার জন্য হুমকি দিয়ে সাবধান করে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় তারা গৌরি ও গিতার সাথে যোগাযোগ করলে তারা এক কাপড়ে রাজশাহীতে চলে এলেন।  আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতা দিলেন সাংস্কৃতি অনুরাগী ব্যাক্তিত্ব হাসানুজ্জামান খোকা (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ)। 

২৫ মার্চ বিকেলে ক্রিড়া সংগঠকদের প্রতিবাদ সভা শেষে সন্ধ্যায় ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর পরিচালনায় গণ সংগীত পরিবেশনের পর অনিল বন্ধু রায়ের সহযোগিতায় আনোয়ারুল ইসলামের পরিচালনায় ‘রক্তের রঙ লাল’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এ সময় আসে পাশে সেনাবাহিনী অস্ত্র সহ অবস্থান নেয়।  নাটকটিতে শিল্পীরা অভিনয় করে দেখালেন কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্যাতন, ধর্ষণ, অত্যাচার করছে। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কিভাবে যুদ্ধ করছে, কিভাবে দেশ স্বাধীন হচ্ছে, পাকিস্তানি সৈন্যরা কিভাবে আত্নসমর্পন করছে। নাটকটি জানিয়ে দিল গেছে মুক্তিযুদ্ধ। বাবার চরিত্রে অভিনয় করেন শেখ আতাউর রহমান ও এ কে এম জাহিদ। ছাত্রনেতার চরিত্রে করেন জাফর ইমাম ও মনসুর রহমান ননী। পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারে ভারসাম্যহীন যুবকের চরিত্রে অভিনয় করেন জাহাঙ্গীর হোসেন। পাকিস্তানি মেজর হুক্কা খানের ব্যঙ্গ চরিত্রে আব্দুর রশিদ ও পাকিস্তানি  আর এক মেজরের চরিত্রে অভিনয় করেন নাটকের লেখক, শেখ আতাউর রহমানের সন্তান ইমরুল কায়েস। শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন দরগাপাড়ার পলি ও রাজাহাতার মানিক। মা ও মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেনন নাটোরের শিল্পী গীতা ও গৌরী। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করলেন আফসার মৃধা, আকবর হোসেন, আইয়ুব, আমজাদ হোসেন, রাজশাহী কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত নাট্যব্যাক্তিত্ব বদিউল আলম ভুলু, নূর মোহাম্মদ, গোলাম পাঞ্জাতন, নুর আহমদ, মোস্তাকিন, মোস্তাফিজুর রহমান। আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেন ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু। রূপসজ্জায় দুঃখু মাস্টারকে সহযোগিতা করলেন নত্য পরিচালক বজলার রহমান বাদল। সার্বিক তত্ত্বাবধানে মোস্তফিজুর রহমান গামা ও আব্দুর রশিদকে কর্মী হিসাবে সহযোগিতা দিলেন সারওয়ার হোসেন বাবলা। নাটকটি দর্শকসহ রাজশাহীর মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলে। প্রতিবাদ সভা, নাটক ও গণসঙ্গীতে অংশ নেয়া সকলেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিলিং স্কোয়াডের হত্যা তালিকায় পড়লেন। 

নাটকটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী জেলা সদর নিঝুম হয়ে গেল। ঐ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এক অফিসার পুলিশ লাইনের ম্যাগজিন রুম থেকে অস্ত্র নিতে চাইলে স্বাধীনতাকামী বাঙালি পুলিশদের কাছে বাধা পেয়ে লজ্জায় ফিরে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা মধ্যরাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ড আব্দুল রাজ্জাক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল হাদির মেজ ভাই আব্দুল হক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্টজন এ্যাডভকেট আব্দুস সালামকে না পেয়ে তার দুই ছেলে বুয়েটের শহীদুজ্জামান সেলিম ও রাজশাহী কলেজের ওয়াসিমুজ্জামান ওয়াসিমকে, ঝাউতলা মোড়ের বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মোঃ মনিরুজ্জামানকে না পেয়ে তার ছোট ভাই সাংস্কৃতিক অনুরাগী ব্যাক্তিত্ব হাসানুজ্জামান খোকা, তার ছোট ভগ্নিপতি ব্যাংক অফিসার সাঈদুর রহমান, রানিবাজার এলাকার বাসিন্দা রেভিনিউ অফিসার দেওয়ান সিদ্দিক, তার শ্যালক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা খোন্দকার আলী আফজালকে ধরে নিয়ে গেলে তারা আর ফিরে আসেনি। তথ্য সুত্রঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাতাব উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আব্দুল মান্নান, বীর মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভকেট মতিউর রহমান, সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন। নাট্যব্যাক্তিত্ব আব্দুর রশিদ।

" target="_blank">


লেখকঃ মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক, রাজশাহী।


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0