আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Journalist Bulbul Ahmed is an eyewitness to the killing of Pakistani soldier

পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা কান্ডের প্রত্যক্ষ দর্শী সাংবাদিক বুলবুল আহমেদ

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল, ২০২৪, ০৯:৫০ এএম

পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা কান্ডের প্রত্যক্ষ দর্শী সাংবাদিক বুলবুল আহমেদ
রাজশাহী টিবি হাসপাতালে পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা কান্ডের প্রত্যক্ষ দর্শী সাংবাদিক বুলবুল আহমেদ

১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বুধবার দুপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী জেলা সদরের টিবি হাসপাতাল নার্সেস হোস্টেলে ত্রাস সৃষ্টি করে হত্যা কান্ড চালায়। তিন জন শহিদ ও কয়েক জন আহত হন। সেদিন ঘটনার প্রত্যেক্ষ দর্শী সাংবাদিক বুলবুল আহমেদ বেচেঁযান। তার বর্ণনায় ঐ সময় তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে পড়তেন। ২৬ মার্চের পর সঙ্গিদের নিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে নষ্ট বাল্প সংগ্রহ করে বিস্ফোরক তৈরীর জন্য সেগুলি লক্ষী পুর পাড়ার স্বাধীনতা কামী ছাত্র নেতা, তরুন যুবকদের পৌছে দিতেন। 

৭ এপ্রিল দুপুরে ইষ্ট পাকিস্তানরা ইফেলস্ (ইপি আর) এর ত্রিশচল্লিশ জন স্বাধীনতা কামী যোদ্ধা তাদের স্টাফ কোয়াটারে এসে তার বাবা হাসপাতালের ষ্টুয়াট আব্দুল বারী হাওলাদার কে জানায় তারা ক্ষুদার্থ। একথাশুনে তার মা ঢামায় করে চাল, ডাল, আলু ও আরো কিছু তাদের দিলে তারা রান্না করে খেয়ে বাংকার খুঁড়তে থাকেন। বুলবুল আহমেদ মাঝে মাঝে মায়ের তৈরী খাবার গাছের ফল তাদের পৌছে দিতেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যান্টনমেন্ট অবরুদ্ধ হয়ে গেল হাসপাতালে। এসময় ষাট সত্তর জন রুগি থাকায় তার বাবা কয়েক জন স্টাফ কে থেকে যেতে বলে রেড ক্রসের পতাকা উড়িয়ে দিতে বলেন। ইতিমধ্যে হাসপাতালের অফিসার স্টাফরা তাদের পরিবারদের অন্যত্র সরিয়ে দেন। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বুলবুল আহমেদের বাবা তাদের রেললাইনের ধারের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে নার্সেস হোস্টেলে নিয়ে আসেন। 

১৩ এপ্রিল সন্ধায় ঢাকা থেকে আসা পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজশাহী জেলা সদর দখল করে নেয়। ১৪ এপ্রিল তারা টিবি হাসপাতালে এসে জিঙ্গা সাবাদ করে চলে গিয়ে ফিরে এসে নার্সেস হোস্টেল আক্রমন করে নামাজরত অবস্থায় তার বাবাকে গুলি করে। পাশের ঘরে থাকা তার বড় ভাই মাহমুদ হোসেন বাদল, (বীর মুক্তিযোদ্ধা) মোহাম্মদ সেলিম গার্ড কাইয়ুব, হেড বাবুর্চি আবুল কালাম ফজল, নাইট গার্ড হাবিব কে গুলি করে। পুরো ঘর রক্ষত্ব হয়ে গেল। গজ তুলা ডেটল দিয়ে আহতদের রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চলে। হাতের উপর কাইয়ুম ও সেলিম মারা যাবার পর সন্ধায় আব্দুল বারি মারা গেলে সবাই দিশে হারা হয়ে যান। 

আহত তার বড় ভাই মাহমুদ হোসেন বাদল খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করতে ব্যার্থ হন। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আহত নাইট গার্ড হাবিব ও হেড বাবুর্চি আব্দুল ফজল খোঁড়াতে খোঁড়াতে হাসপাতালে চলে যান। প্রচন্ড ঝড় বৃষ্ঠি ও রক্তে ভেজা কাপড়ে তিনি মা কে নিয়ে সারা রাত হেটে মঙ্গোনপুর গ্রামে গেলে হাসপাতালের পরিচিত জনরা তাদের চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সরকার সরকারী লোক জন কে কর্ম স্থলে যোগ দিতে রেডিওর মাধ্যমে ঘোষণা দিলে বুলবুল আহমেদরা হাসপাতালটির স্টাফদের সাথে ফিরে এসে দেখেন সব কিছু লুঠপাঠ হয়ে গেছে। শহিদের মৃত দেহ তিনটি পচে ফুলে গেছে খুবই দুর্গন্ধ। পাশেই কবর খুড়ে জানালার পুরানো পর্দা বিছানার চাদর দিয়ে শহিদের দেহগুলি জড়িয়ে ভাঙ্গা দরজার উপর একটা একটা করে বাইরে এনে দাফন করে সন্ধার দিকে গ্রামটিতে ফিরে গেলেন। 

দুই মাস পর ফিরে এসে খবর পেলেন বড় ভাই মাহমুদ হাসান বাদল তাদের খুঁজেনা পেয়ে সীমান্ত পার হয়েছেন। বিজয়ের পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে তারা ঢাকা চলে যান। প্রতিবছর কবর জিয়ারত করতে রাজশাহী আসতেন। কবরটি ঘিরে দিলেও কারা যেনো বেরা গুলি খুলে দিয়ে যেত। ১৯৯৭ সালে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ সংবাদ পত্রে কর্মরত কালীন সময়ে রাজশাহীতে একটা এ্যাসাইমেন্ট পেলে সহকার্মী পিন্টু দাস গুপ্ত কে সঙ্গে নিয়ে আসেন। জাঙ্গলের মধ্যে কবরের পাশে অনেক ক্ষণ ধরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে পিন্টু দাস গুপ্ত তাকে সেখানে থেকে চলে আসতে বলেন। কারণ পিন্টু দাস গুপ্ত তখনও বিষয়টি জানতেন না। বুলবুল আহমেদ তাকে জানান এখানে তার অনেক স্মৃতি আছে। 


এরপর তারা হাসপাতালটির পরিচালকের কাছে যান। বুলবুল আহমেদ তাকে জিঙ্গাসা করেন সেখানে কয়জন শহিদ হয়েছেন উত্তরে তিনি জানান কেউ শহিদ হয়নি। তিনি তার কাছে আহত নাইট গার্ড হাবিব ও হেডবাবুর্চি আবুল ফজলের পা কিভাবে কাটা গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন সম্ভবত তাদের পা দূর্ঘটনায় কেটে গেছে। পরিচালক নিজের কথা বলতে গিয়ে বলেন তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টর্রনী করার সময় মুক্তিযুদ্ধে যোগদেন। বুলবুল আহমেদ তার বাবার কথা বলতেই পরিচালক বলেন তিনি তাকে চিনতেন তিনি তো ঢাকার। তিনি তাকে চেনেন কিনা এখন তিনি কোথায় ? বুলবুল আহমেদ তাকে বলেন ঐ আম গাছের নিচে। পরিচালক সাহেব অবাক হয়ে গেলেন।

পরিবেশ অন্য রকম হয়ে গেল, বললেন তিন চার বছর ধরে সেখানে আছেন কিন্তু কেউ তাকে এঘটনা জানায়নি। পরিচালক সাহেব সব কথা শুনে তাকে স্নেহের সাথে করে কবরের কাছে নিয়ে গিয়ে, হাসপাতালের সকলকে ডাকলে সকলে বলেন ঘটনা সত্য। রেনোভেশন করা কনট্রাকটর কবরটি বাঁধিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন। পরিচালক সাহেব পরের দিন তাদের ডাকলে পরের দিন বুলবুল আহমেদ ও পিন্টু দাস গুপ্ত সেখানে গিয়ে দেখেন এক হাত গাথুঁ নিহয়ে গেছে। পরিচালক সাহেব বুলবুল আহমেদ কে ঢাকা থেকে নাম ফলক তৈরি করে নিতে বললেন। 

বুলবুল আহমেদ ঢাকায় ফিরে বড় ভায়ের সাথে কথা বলে নাম ফলকটি তৈরি করে সকলের সাথে আলোচনা করে, তিনদিন আগে রাজশাহীতে এসে শহিদদের কবরে সেটি লাগিয়ে দেন। তিন দিন পর পরিবারের সদস্যরা সেখানে এলে হাসপাতালের স্টাফরা রান্নার আয়োজন করেন। কোর-আন খতম,  মিলাদ মাহাফিল, দোয়া, স্মৃতিচরণ হয়। প্রতি বছর বুলবুল আহমেদ পরিবারের কাউ কেনা কাউ কেনিয়ে আসেন, না আসতে পারতে ও রাজশাহী প্রেসক্লাব ও আতাউ ররহমান স্মৃতি পরিষদ কর্মসূচী পালন করে। একবার বুলবুল আহমেদ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের আয়োজনে পাকিস্তানে যাবার আমন্ত্রণ পেলেএকথা জেনে তার মেয়ে সংবাদ পত্রের চেয়ারম্যানকে ঘটনাটি জানিয়ে তার বাবা কে পাকিস্তানে না পাঠিয়ে অন্য জায়গায় পাঠাকে অনুরোধ করলে তিনি তাই করেন। 

দুঃজনক এখানে অন্য আয়োজন হলেও শহিদদের জন্য কোন আয়োজন হয় না। এখন যারাএই প্রতিষ্ঠানের সাথে সংপৃক্ত তারা ঘটনা জানেন না বরং ঘটনাটি এরিয়ে যান। বুলবুল আহমেদের বাড়িতে পাকিস্তানি কোন জিনিস দেখতে পাওয়া যায়না। পাকিস্তানি গান টিভি চ্যানেল একেবারে নিশিদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিলের ঘটনাটি রাজশাহী সিটি মেয়র, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংশ্লিষ্টরা অবগত। প্রত্যাশা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শহিদের নিয়ে আয়োজনের উৎদ্যেগ নেবেন। নার্সেস হোস্টেলে শহিদহওয়া ব্যক্তি বর্গদের স্বরণে তৈরি হবে স্মৃতি সৌধ। 

লেখক মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক রাজশাহী।


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0