আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, সোমবার, মে ২০, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Human Rights Act

বাল্যবিবাহ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন

Bijoy Bangla

অনলাইন ডেস্ক:

প্রকাশিত: ১২ জানুয়ারী, ২০২৪, ০৩:২৭ পিএম

বাল্যবিবাহ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন

বাংলাদেশ বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যার মধ্যে রয়েছে- মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র ১৯৪৮ (ইউডিএইচআর), কনভেনশন অন দ্য ইলিমেনশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন ১৯৭৯ (সিডও), কনভেনশন অন দ্য কনসেন্ট টু ম্যারেজ, মিনিমাম এইজ ফর ম্যারেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব ম্যারেজ (১৯৬২), ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন ইকোনমিক, সোশ্যাল, অ্যান্ড কালচারাল রাইটস ১৯৬৬ (আইসিইএসসিআর), কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড ১৯৮৯ (সিআরসি) এবং ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস ১৯৬৬ (আইসিসিপিআর) ইত্যাদি।

আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত মেম্বার স্টেটগুলোকে বিবাহের একটি ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ করতে এবং তার আগে সমস্ত বিবাহকে ‘বাল্যবিবাহ’ হিসেবে সম্বোধন করার আহ্বান জানায় [২]। এসব বাল্যবিবাহকে আইনত অবৈধ সম্বোধন করা হয়েছে [৩] এবং ঘোষণা করা হয়েছে যে বিবাহ অবশ্যই স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে পরিচালিত হতে বাধ্য [৪]। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুরা এই সম্মতি প্রদানের জন্য যথেষ্টভাবে পরিপক্ব নয়।

উপরন্তু, বিবাহগুলোকে অবশ্যই রেজিস্টার্ড বা নিবন্ধিত হতে হবে যা বিবাহের নথিভুক্ত প্রমাণ হিসেবে থাকবে [৫]। অতঃপর, বিবাহের সময়, বিবাহের সম্পর্কে থাকাকালীন এবং বিবাহ বিচ্ছেদে স্বামী-স্ত্রীর সমান অধিকার এবং দায়িত্ব রয়েছে বলে ট্রিটিগুলোয় ঘোষণা করা হয়েছে [৬]। এছাড়াও, কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (সিআরসি) শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলোর একটি বিশদ কাঠামো নির্ধারণ করেছে যেগুলোর বিষয়বস্তু মূলত বাল্যবিবাহের কারণে শিশু অধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।

উক্ত অধিকারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- অবৈষম্য [৭], রাইট টু লাইফ [৮], ইচ্ছার বিরুদ্ধে অভিভাবক থেকে  বিচ্ছিন্ন না থাকার অধিকার [৯], জন্মের পরে নিবন্ধিত হওয়ার অধিকার [১০], শিক্ষার অধিকার [১১], স্বাস্থ্যের অধিকার এবং অপকারক অনুশীলন থেকে রক্ষার অধিকার [১২] এবং শোষণ ও নিপীড়ন হতে রক্ষার অধিকার [১৩] ইত্যাদি।

বাংলাদেশ কর্তৃক লঙ্ঘনকৃত আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাসমূহ :

বাংলাদেশ বরাবরই বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনসমূহ লঙ্ঘন করে এসেছে। বাংলাদেশ কনভেনশন অন দ্য ইলিমেনশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন ১৯৭৯ (সিডও) স্বাক্ষর করেছিল ইহার অনুচ্ছেদ (আর্টিকেল) ২ এবং অনুচ্ছেদ ১৬(১)(সি) এ রিজার্ভেশন রেখে। চুক্তি (ট্রিটি) রিজার্ভেশন কোনো চুক্তি বা  ট্রিটির নির্দিষ্ট কিছু অংশের বাধ্যবাধকতা রোধ করে।

অনুচ্ছেদ ২ এবং অনুচ্ছেদ ১৬(১)(সি) নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং বিবাহে অধিকারের সমতাবিষয়ক বাধ্যবাধকতা নির্দেশ করে যা কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। তাই সিডও কমিটি বাংলাদেশকে রিজার্ভেশন টি প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে কারণ রিজার্ভেশন টি কনভেনশনের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক [১৪]। বাংলাদেশ উক্ত রিজার্ভেশন টির ব্যাপারে যুক্তি দিয়েছে যে আর্টিকেলগুলো স্থানীয় ধর্মীয় আইন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কিন্তু সিডও কমিটি এবং জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কমিটি রেকমেন্ডেশনস অনুযায়ী- ধর্ম, প্রথা, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি ইত্যাদিকে নারী অধিকার লঙ্ঘনের ন্যায্যতা প্রদানের জন্য ব্যবহার করা যাবে না এবং সকল কিছুর পূর্বে গুরুত্ব পাবে নারীদের প্রতি ন্যায় ও সমতার নীতিটি [১৫]। 

এছাড়াও, বাংলাদেশ ‘কনভেনশন অন দ্য কনসেন্ট টু ম্যারেজ, মিনিমাম এইজ ফর ম্যারেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব ম্যারেজ’ স্বাক্ষর করেছে তার অনুচ্ছেদ ১ এবং ২ তে রিজার্ভেশন রেখে যেখানে বিবাহের বিষয়ে সম্পূর্ণ সম্মতির বিধান এবং বিবাহের ন্যূনতম বয়সের নির্দিষ্টকরণ বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের উক্ত রিজার্ভেশনটিও কনভেনশনটির মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

উপরন্তু, পূর্ববর্তী চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন অ্যাক্ট, ১৯২৯ বাতিল করে বাংলাদেশ চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন অ্যাক্ট, ২০১৭ পাস করেছে। উক্ত আইনের ধারা ১৯ এ মেয়ের সম্মতি ছাড়াই ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে’ শুধু পিতামাতার এবং কোর্টের সম্মতিতে বাল্যবিবাহের অনুমতি দেয়। উল্লিখিত বিশেষ পরিস্থিতিগুলোও আইনটিতে নির্দিষ্ট করা হয়নি। উক্ত আইনটি কনভেনশন অন দ্য ইলিমেনশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন এগেইনস্ট উইমেন ১৯৭৯ (সিডও) এর আর্টিকেল ১৬(১), ইন্টারন্যাশনাল কভেনান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস ১৯৬৬ (আইসিসিপিআর) এর আর্টিকেল ২৩(২) এবং ‘কনভেনশন অন দ্য কনসেন্ট টু ম্যারেজ, মিনিমাম এইজ ফর ম্যারেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব ম্যারেজ’-এর অনুচ্ছেদ ২ তে উল্লেখ্য, বিবাহের ন্যূনতম বয়স সম্পর্কিত বিধানের সরাসরি বরখেলাপ করে। 

এছাড়া, যদিও আইনে বাল্যবিবাহের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে, কিন্তু বাল্যবিবাহটিকে স্বয়ং অবৈধ ঘোষণা করার কোনো বিধান নেই। তাই জড়িতদের শাস্তি হলেও বিবাহটি কার্যকর থেকে যায়। এই অনুশীলনটি সিডও এর অনুচ্ছেদ ১৬(২) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক যা ঘোষণা করে বাল্যবিবাহের কোনো ‘লিগ্যাল ইফেক্ট’ বা বৈধ আইনি কার্যকারিতা নেই।

অধিকন্তু, বাংলাদেশের বিবাহ সম্পর্কিত বিষয়গুলো পরিচালনা করার জন্য ধর্মীয় আইনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। উক্ত ব্যক্তিগত আইনগুলোতে সাধারণত রেজিস্ট্রেশন ছাড়া বিবাহ কার্যকর হয়, যা সিডও এর অনুচ্ছেদ ১৬(২) এবং ‘কনভেনশন অন দ্য কনসেন্ট টু ম্যারেজ, মিনিমাম এইজ ফর ম্যারেজ অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অব ম্যারেজ’ এর অনুচ্ছেদ ৩ এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ্য যে, মুসলিম আইনে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক তবে ইহার ব্যবহারিক প্রয়োগ স্থানীয় অনুশীলনে কার্যকরভাবে নির্বাহ করা হয়নি। বাংলাদেশের বাল্যবিবাহবিষয়ক সামগ্রিক আইনগত অনুশীলন পূর্বে উল্লিখিত সিআরসি ১৯৮৯ এ নির্ধারিত শিশু অধিকারগুলোরও লঙ্ঘন করে।

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সমস্যার কারণসমূহ :

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ আইন সমস্যার একটি মূল কারণ হলো বিবাহ পরিচালনার জন্য ব্যক্তিগত আইনের ব্যাপক অনুসরণ [১৬]। এই আইনগুলি স্থানীয় রীতিনীতি এবং স্থানীয় ধর্মীয় চর্চার উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়ে থাকে। এই ব্যক্তিগত আইনসমূহে সাধারণত বাল্যবিবাহের সরাসরি নিষেধাজ্ঞা থাকে না, বিয়ের ন্যূনতম বয়সের উল্লেখ থাকে না, রেজিস্ট্রির কোনো বিধিবিধান থাকে না, বিবাহের ক্ষেত্রে অনেক ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ সম্মতির সংগতি থাকে না, বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারে অসমতা দেখা যায় এবং অনেক ক্ষেত্রেই বহু বিবাহ প্রথা লক্ষণীয় থাকে যেগুলো উপরে উল্লিখিত বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক বিধানের সঙ্গে সংঘর্ষ করে।

বাল্যবিবাহ বিষয়ক জাতীয় আইন থাকার পরেও সেগুলো স্থানীয় ব্যক্তিগত আইনের সঙ্গে সরাসরি সংগতিপূর্ণ না হওয়ার কারনে রাষ্ট্র উক্ত আইনগুলোর প্রয়োগে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে [১৭]। তাছাড়া স্থানীয় প্রথাগুলির সঙ্গে মিল রেখে আইন প্রণালীর যথাযথ সংস্কার সাধনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সমস্যাটিকে ত্বরান্বিত করেছে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং জাতীয় আইনের মধ্যে কনফ্লিক্ট  মূলত একটি ওভারল্যাপিং আইনি ব্যবস্থার সৃষ্টি করে যা আইনের সর্বাত্মক বাস্তবায়নকে জটিল করে তোলে।

তাছাড়া, বাল্যবিবাহ রোধে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা এখনো অপর্যাপ্ত। উক্ত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশকে আইন লঙ্ঘন করার জন্য পেনালটি দিতে হতে পারে। তবে যে সকল বিধানগুলো রিজার্ভেশনের আওতাভুক্ত, সেগুলোর জন্য বাংলাদেশ দায়ী হবে না।

বর্তমান অবস্থায়, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে স্থানীয় আইনকে সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে একীভূত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অধিকন্তু, চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন অ্যাক্ট, ২০১৭ ধারা ১৯ এ প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। সম্মতিবিহীন কোনো বিবাহের বিধান থাকা যাবে না এবং ১৮ বছরের পূর্বে সকল পরিস্থিতিতে সকল বিবাহকে বাল্যবিবাহ এবং আইনত অবৈধ বলে আখ্যায়িত করতে হবে। প্রতিটি শহর, গ্রাম, ইউনিয়ন ও জেলায় সাধারণ মনিটরিং ব্যবস্থা এবং বিবাহ রেজিস্ট্রি প্রক্রিয়া কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে। সর্বশেষে, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তুলতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সচেতনতামূলক কর্মসূচি ও প্রচারণা চালাতে হবে।


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0