আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, শুক্রবার, জুলাই ১০, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২১ আষাঢ় ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

Awami League leader Ashraful Islam Babul

যে সব কারনে প্রাণ দিতে হল আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলকে

Bijoy Bangla

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৭ জুন, ২০২৪, ০২:১২ পিএম

যে সব কারনে প্রাণ দিতে হল আওয়ামী লীগ নেতা বাবুলকে
আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুল

রাজশাহীর বাঘা উপজেলা সাবরেজিস্ট্রি কার্যালয়ের দলিল লেখক সমিতির কমিটি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফুল ইসলাম বাবুল মারা গেছেন। বুধবার বিকেলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মাথায় ধারালো অস্ত্রের কোপ ছিল।

আশরাফুল ইসলাম বাবুল বাঘা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর আগে টানা দুবার তিনি উপজেলা যুবলীগের সভাপতিও ছিলেন। এছাড়াও ছাত্রজীবনেও তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন।

দলিল লেখক সমিতির কমিটি নিয়ে চলতি মাসে দুই দফা সংঘর্ষে অন্তত ৪৫ জন আহত হয়েছেন। সবশেষ গত শনিবার (২২ জুন) উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অন্তত ৩০ নেতা-কর্মী আহত হন। সেদিন সকাল বেলা ১১ থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা উপজেলা পরিষদ চত্বরে এ সংঘর্ষ চলে। এ সময় একাধিক হাত বোমার বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় উপজেলা চত্বরের ভেতর থেকে আশরাফুল ইসলাম বাবুলকে উদ্ধার করা হয়।

দলিল লেখক সমিতির কমিটি আগে নির্বাচিত হতো। ২০১৯ সাল থেকে স্থানীয় সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম মৌখিকভাবে সমিতির কমিটি করে দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত চারটি পকেট কমিটি করে দিয়েছেন সংসদ সদস্য। দলীয় পদধারী নেতারাই এসব কমিটিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা সবাই সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

সমিতির সাবেক সভাপতি জহুরুল হকসহ ৬৯ জন দলিল লেখক গত ১২ মে বর্তমান কমিটি বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে তাঁরা উল্লেখ করেছেন, দলিল লেখকদের বাধ্য করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এতে জমি রেজিস্ট্রি কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্র রাজস্ব হারাচ্ছে।

দলিল লেখকেরা জানিয়েছেন, সর্বশেষ ৭ জুন মৌখিকভাবে সমিতির নতুন কমিটি করে দেন সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। এতে সভাপতি হন উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহিনুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক পদ পেয়েছেন পাকুড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সামিউল আলম ওরফে নয়ন সরকার। এই কমিটি হওয়ার পর থেকেই দলিল লেখকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।


স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ জুন সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিল লেখক সমিতির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। পরে ২০ জুন দলিল লেখক সমিতির কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান লায়েব উদ্দিন ও পৌর মেয়র আক্কাস আলীর অনুসারীরা। এরপর ২২ জুন আবারও পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে এই পক্ষের সঙ্গে সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলমের পক্ষের লোকজনের সংঘর্ষ বাধে।

সমিতির সাবেক নির্বাচিত সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, অনির্বাচিত কমিটি অনেক দিন ধরেই জুলুম করে আসছে। তাদের কারণে কোণঠাসা সাধারণ মানুষ।

নেপথ্যে চাঁদাবাজি

বাঘা পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. কুদ্দুস এক মাস আগে পৌর এলাকায় ১৮ কাঠা জমি কিনেছেন, তবে এখনো নিবন্ধন করতে পারেননি। মৌজা দর ২৫ হাজার টাকা কাঠা ধরে এই জমির দাম ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ ধরনের জমি নিবন্ধনে সাড়ে ৯ শতাংশ ফি দিতে হয়। সেই হিসাবে ফি আসে ৮০ হাজার ৭৫০ টাকা। কিন্তু দলিল লেখক সমিতি বাড়তি ৪৭ হাজার ২৫০ টাকা দাবি করে।

মো. কুদ্দুসের মতো বাঘার অনেকেই এই অতিরিক্ত টাকা দাবির কারণে জমি কেনাবেচা করেও দলিল করতে পারছেন না। একটি দলিল করতে বৈধ যে খরচ হওয়ার কথা, দলিল লেখক সমিতি তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দলিল লেখক সমিতির নতুন সভাপতি শাহিনুর রহমান বলেন, আগের কমিটিগুলো দুর্নীতি করেছে। এ কারণেই নতুন কমিটি করে দিয়েছেন সংসদ সদস্য। তিনি দাবি করেন, জমি নিবন্ধন বাবদ জমির মূল্যের প্রতি এক লাখ টাকার বিপরীতে সমিতি পাঁচ হাজার টাকা নেয়। এর মধ্যে দলিল লেখক খরচও থাকে। অনেক সময় তদবিরে পাঁচ হাজার টাকার কমও নেওয়া হয়।


আবদুর রহমান নামের এক দলিল লেখক (মুহুরি) বলেন, তার কাছে সাধারণত কাছের আত্মীয়স্বজনই জমি রেজিস্ট্রি করতে আসেন। তাদের কাছ থেকে তো আর বেশি টাকা নেওয়া যায় না; কিন্তু সমিতির চাপে কিছুই করার থাকে না। অনেক সময় নিজের নির্ধারিত ফি না নিয়ে উল্টো সমিতিতে পকেট থেকে টাকা দিতে হয়। এই সমিতির টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারার ক্ষেত্রেও কোনো হিসাব নেই।

আইনে যা আছে

১৯৯৪ সালে আইন ও বিচার বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনে দলিল লিখতে পাতা প্রতি (৩০০ শব্দ) ১৫ টাকা হারে মুহুরির ফি নির্ধারিত ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নতুন করে দলিল লেখক (সনদ) বিধিমালা-২০১৪ প্রকাশিত হয়। সেখানে ফির বিষয়ে উল্লেখ নেই।

বাঘা উপজেলায় নিবন্ধিত দলিল লেখক ১৬৫ জন। ২০১৯ সালের আগে দলিল লেখকেরা ক্রেতাদের সঙ্গে দরাদরি করে সম্মানী নিতেন। সঙ্গে কিছু টাকা সমিতিতে জমা দিতেন।

দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে অনির্বাচিত দলিল লেখক কমিটি গঠনের পর নেতারা মুহুরিদের প্রলোভন দেখান, প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে লেখক কোনো সম্মানী নেবেন না। তিনি সমিতির নির্ধারিত ফি নিয়ে সমিতিতে জমা দেবেন। সমিতি দিনের শেষে দলিল লেখককে প্রতিটি দলিল লেখার বিপরীতে নগদ ২৫ শতাংশ বিল বুঝিয়ে দেবে। বাকি টাকার একটি অংশ সমিতিতে জমা হবে। বাকি প্রাপ্য অংশ সমিতির নেতারা প্রতি সপ্তাহে ১৬৫ জন দলিল লেখকের মধ্যে বণ্টন করে দেবেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করেননি সমিতির নেতারা। সম্মানীর টাকা সেই থেকে আর নিয়মিত পাচ্ছেন না দলিল লেখকেরা।

বাঘার পাশেই চারঘাট উপজেলা। সেখানে প্রায় এক বছর ধরে দলিল লেখক সমিতি নেই। চারঘাটের দলিল লেখক আজিজুল আলম বলেন, তাঁদের ওখানে একেকটি দলিল লেখা বাবদ খরচ হিসেবে তাঁরা ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা নেন।

জানতে চাইলে বাঘার সাবরেজিস্ট্রার এন এ এম নকিবুল আলম বলেন, সরকার নির্ধারিত টাকা দিয়ে জমি নিবন্ধন করতে হয়। এ জন্য ব্যাংকে ট্রেজারির মাধ্যমে টাকা জমা দিতে হয়। এর বাইরে আর কোনো বাড়তি টাকা নেওয়া হয় না। এখন মুহুরি বা অন্যরা বাড়তি টাকা নিতে পারেন। বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

বাঘার পাকুড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা আশরাফ আলী এক মাস আগে ৪ কাঠা জমি ৪০ হাজার টাকা দরে কিনেছেন। তাঁকে মুহুরি জানান, রেজিস্ট্রি করতে দলিল লেখক সমিতিতে আলাদা করে দিতে হবে ৪০ হাজার টাকা। এই টাকা তিনি দেননি। ফলে জমিও আর রেজিস্ট্রি করতে পারেননি।

আশরাফ আলী বলেন, জমি কেনার পর প্রথম কাজই হলো নিবন্ধন করা; কিন্তু সেটা তিনি করতে পারেননি।

google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0