আর্কাইভ কনভাটার ঢাকা, বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Logo

18th February 1869

শিক্ষক-ছাত্রের রক্তে উত্তাল ৬৯ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি

Bijoy Bangla

ওয়ালিউর রহমান বাবু

প্রকাশিত: ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০৭:২৯ এএম

শিক্ষক-ছাত্রের রক্তে উত্তাল ৬৯ এর ১৮ ফেব্রুয়ারি

এই দিনটি শিক্ষক-ছাত্র দিবস ঘোষণা করা হক

১৯৬৯ সালে শহীদ নুরুল ইসলাম ছিলেন রাজশাহী সিটি কলেজের ছাত্র। করতেন পুর্ব পাকিস্থান ছাত্র ইউনিয়ন। সংগঠনের সম্মেলনে ঢাকা যান। ১১ দফা আন্দোলন তখন তুঙ্গে। একটি মিছিলে থাকা ঢাকা নবরূপ স্কুলের ছাত্র মতিউর শহিদ হলে তার রক্তে লাল হয়ে যায় ছাত্রনেতা নুরুল ইসলামের পোষাক। শহিদ মতিউর এর লাশ নিয়ে ঢাকা কাপিয়ে দেন ছাত্র নেতা নুরুল ইসলাম। রাজশাহী ফিরে আন্দলনকে তীব্র করতে থাকেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার ও গণ নির্যাতনের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পালিত হয় ধর্মঘট। এই দিন বিকেলে পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনি গ্যাসে আহত হন ১৬ জন ছাত্র। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তৎকালীন প্রোক্টর, রসায়ন বিভাগের শিক্ষক প্র. ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা আহত ছাত্রদের কাছে এসে তাদের বুকে টেনে নিয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানান। আহত ছাত্রদের নিজের গাড়িতে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে বলেন, “ভয় নেই আমরা আছি তোমাদের পাশে…” বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা দিবসের কর্মসুচি রূপ নিল প্রতিবাদ সভায়। রাত ১০টার দিকে কলা ভবনের সামনে শহিদ মিনারে প্রতিবাদ সভায় তিনি বক্তব্যে অন্যায় এর প্রতিবাদে থাকার শপথ নিলেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি জারি করা হয় ১৪৪ ধারা। নামানো হয় ইপিআর, সেনাবাহিনী।

১৪৪ ধারা ভেঙ্গে রাজশাহী জেলা সদরের মধ্য শহরে ছাত্র জনতার আন্দোলন তখন তীব্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মধ্যশহরে আসার প্রস্তুতি নিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন গেটের সামনে থাকা সেনাবাহিনীর অফিসাররা শিক্ষক ছাত্রদের অকাট্ট ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। এক অফিসার গুলির নির্দেশ দেয়। সেখানে গিয়ে চিৎকার করে বলেন, “প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছাত্ররা ভিতরে চলে যাবে”। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এস আলি আশরাফ। ছাত্ররা যখন ক্যাম্পাসে ফিরছে, সেখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ছাত্রদের একটি অংশ ছাত্ররা সহ্য করতে না পেরে  সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ্ এর অস্ত্র নিয়ে নেবার চেষ্টা করলে ধস্তাধস্তি শুরু হলে লেফটেন্যান্ট মিনু লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ্ কে সৈনিকদের প্রস্তুত করতে বললে লেফটেন্যান্ট খাদেম শাহ্ বাঙালি এক সৈনিকের কাছে থাকা মার্কফোর রাইফেল নিয়ে গুলি চালালে গুলি প্র. ড. শামসুজ্জোহার শরীরের মধ্যে পেঁচিয়ে ঢুকে বেয়েনট চার্জের মত ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। আহত হন প্র. ড. আব্দুল খালেক(সাবেক উপাচার্য) প্র. ড. কছিমউদ্দিন মোল্লা, প্র. ড. আব্দুল মান্নান প্রমুখ। আহত শিক্ষকদ্বয় উপস্থিত ম্যাজিস্ট্রেট নাসিম কে প্র. ড. পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলে তারা তা উপেক্ষা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এই খবর মধ্য শহরে আন্দোলনকারীদের কাছে এলে তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তৎকালীন পৌরসভা ভবনের ছাদে থাকা ইপিআর বাহিনী গুলি চালালে সোনাদীঘি মসজিদের সামনে ছাত্রনেতা নুরুল ইসলাম শহিদ হন। তাকে রাস্তায় ছেঁচরিয়ে পা ধরে টেনে এনে পৌরসভা ভবনে রাখা হয়। মিছিলে আসা বড় ভাই আব্দুল আজিজ (বীর মুক্তিযোদ্ধা) কে খুঁজতে এসে বন্ধু মসলেম সহ অন্যান্যদের সঙ্গে আসা হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাই স্কুল (হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাই মাদ্রাসা) সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুল সাত্তার রাজশাহী কলেজের মহিলা হোস্টেলের পার্শে গুলি বিদ্ধ হলে তাকে ছেঁচরিয়ে টেনে পৌরসভা ভবনে আনলে এক গাড়িচালক কৌশলে তাকে চেনে বলে হাসপাতালে পাঁঠিয়ে দেন। তার বন্ধু মোসলেম ও সেদিন আহত হন। প্র. ড. সামসুজ্জহাকে খোলা গাড়িতে করে এনে পৌরসভা ভবনের একটি ঘরে এবং আহত শিক্ষকদের আরেকটি ঘরে বন্দি রাখা হয়। এখানে প্র. ড. কছিমউদ্দিন মোল্লা অজ্ঞান হয়ে গেলে প্র. ড. আব্দুল খালেক সুইপারদের দিয়ে সোনাদিঘি থেকে পানি আনিয়ে তার মুখে ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরান। তাদের প্রতিবাদে হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আনা হয়। তারা প্র. ড. শামসুজ্জোহা কে দ্রুত হাসপাতালে নিতে বললে তাকে সেখানে নেয়া হয়। তিনি সেখানে বলেন, তারাতারি তাকে নিয়ে আসলে তিনি বেঁচে যেতেন। লাশ নিতে শহিদ নুরুল ইসলামের পিতাকে শর্ত দেয়া হয়। প্র. ড. শামসুজ্জহা রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার লাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিয়ে গেলে ছাত্র জনতার ভীর বাড়তে থাকে। আহত বন্দি শিক্ষকদের মুক্তি দিয়ে রেডক্রশের গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেয়া হয়। রাজশাহীর খবরে সারা দেশে কেপে উঠে।

লৌহমানব ক্ষ্যাত প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পাল্টে গেল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। মুক্তি পেলেন বাঙালিদের অসাংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমান। তাকে দেয়া হল বঙ্গবন্ধু উপাধি। আহত ছাত্র আব্দুস সাত্তারের শরীরে পচন ধরে ছয় মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। এখানেই শেষ নয়, শহিদ নুরুল ইসলামের পিতা এই অপরাধে রেলওয়ে কলোনির অবাঙালি আমজাদ রেলওয়েতে কর্মরত সুফি আব্দুল কুদ্দুসকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পুর্ব মুহুর্তে ২০ এপ্রিল হত্যা করে। অবাঙালিরা তার বাড়িতে লুটপাটের সময় তার আরেক সন্তান রেজাউল করিমকে নির্যাতন করে। পরিবারটিতে দেখা দিল শঙ্কট। সব কিছু মেনে নিয়ে তারা স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনঃবাসন মন্ত্রি, বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদ এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান হেনা এই দুই পরিবারের খোজ খবর রাখতেন। ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন নুরুল ইসলামের ভাই সৈয়দ আব্দুল্লাহ হারুন কে কতিপয় ব্যাক্তি ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেন। পরের বছর ২৬ জুলাই তিনি মারা যান। পরিবারদ্বয়ের অভিযোগ ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পর এই দুই পরিবারের কেউ খোঁজ রাখেনি। জানা যায় মুক্তিযোদ্ধা, ন্যাপ নেতা এ্যাড. এম আতাউর রহমান, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীরা নানাভাবে পরিবারদ্বয়ের খোঁজখবর নিতেন। কিন্তু সেটিও বন্ধ হয়ে যায়।  শহিদ নুরুল ইসলামের ছোট ভাই সিদ্দিকুর রহমানকে বীর মুক্তিযোদ্ধা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পুলিশ বিভাগে চাকুরী দেন। কিন্তুবিরোধের কারণে সেই চাকুরী ছেড়ে তিনি রেলওয়েতে যোগ দেন। তারও রহস্যজনক মৃত্যু হয়। পরিবারটির সংকট তীব্র হতে থাকে। রোগে শোকে ১৯৯০ সালে  মারা গেলেন শহিদ নুরুল ইসলামের মা সৈয়দা আয়েশা সিদ্দিকা। এই পরিবারটি শহিদ জননী জাহানারা ইমাম ও ভাষা সৈনিক শহিদ আবুল বরকতের স্বজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করেন শহিদ প্র. ড. শামসুজ্জোহার নামে। তৎকালীন রাজশাহী  পৌরসভা শহিদ আব্দুস সাত্তারের স্মরণে জেলা সদরের পাঠানপাড়ায় একটি রাস্তার নামকরণ করেন। কিন্তু নামফলকটির এখন আর অস্তিত্ব নেই। শহিদ নুরুল ইসলাম হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাই স্কুল (হাজী মুহাম্মদ মুহাসীন হাই মাদ্রাসা) এর ছাত্র ছিলেন। সাবেক সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশাহর চেষ্টায় কর্তৃপক্ষ এখানকার ছাত্রাবাসের নাম শহিদ নুরুল ইসলাম-শহিদ আব্দুস সাত্তারের নামে নামকরণ করেন। জানা গেছে রাজশাহী সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ শহিদ নুরুল ইসলামকে স্মরণীয় করে রাখতে উদ্যোগ। ১৮ ফেব্রুয়ারি শিক্ষক-ছাত্র দিবস ঘোষণার দাবি দীর্ঘদিনের। এই দিন শিক্ষক-ছাত্রের রক্তে স্বাধীনতার আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধের মেইল ফলক রচিত হয়। তথ্য সুত্রঃ প্র. ড. আব্দুল খালেক সাবেক উপাচার্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শহিদ নুরুল ইসলামের বন্ধু বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ছাত্রনেতা জালাল উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ছাত্রনেতা মতিউর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ছাত্রনেতা রুহুল আমিন প্রামাণিক, শহিদ আব্দুস সাত্তারের ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ছাত্রনেতা সাইদুর রহমান,বীর মুক্তিযোদ্ধা সাবেক ছাত্রনেতা শাহজাহান আলী বরজাহান, শহিদ নুরুল ইসলামের ঘনিষ্টজন গবেষক লেখক মাহমুদ সিদ্দিকি, সিনিয়র সাংবাদিক মঞ্জুরুল হক, সিনিয়র সাংবাদিক আহমেদ সফিউদ্দিন, শহিদ নুরুল ইসলামের স্বজন, বিন্দু আতাউর রহমান স্মৃতি পরিষদ।                 

লেখকঃ মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রাহক।


google.com, pub-6631631227104834, DIRECT, f08c47fec0942fa0